সোমবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সন্ত্রাসীযুগলের প্রেম কাহিনি

তানভীর আহমেদ

সন্ত্রাসীযুগলের প্রেম কাহিনি

ত্রিশের দশক। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত কিন্তু সন্ত্রাসীযুগল বনি পার্কার ও ক্লাইড ব্যারো। প্রচলিত আইন ভাঙা ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। শীর্ষ অপরাধী হিসেবে মিডিয়াতে ছিল ব্যাপক আলোচিত। সাধারণ মানুষের কাছেও তারা অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই পরিচিতি লাভ করে। এ দুজনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চুরি আর খুনের ঘটনা। বনি পার্কার তখন ঘুরত গুলিভরা রাইফেল হাতে আর ক্লাইড ব্যারোর কাজ ছিল ব্যাংক লুট করা। টাকা-পয়সার কমতি ছিল না তাদের। তবুও একের পর এক ব্যাংক লুটের ঘটনায় তারা ক্রমেই ফুলেফেঁপে উঠেছিল। এ দুজনের ব্যাংক লুুটের ঘটনা যে কোনো ফিল্মি ঘটনাকেও হার মানায়। আগে থেকে ব্যাংক চিহ্নিত করত তারা। চুরির বিস্তারিত পরিকল্পনা করে তারপর সুযোগ বুঝে ব্যাংকে হামলা করে টাকা লুট তাদের কাছে ছেলেখেলা ছিল। লুটেরাদের পেছনে পুলিশ ছুটেছে আর তারা ছুটেছে দুরন্ত গতির গাড়িতে। ছোট পরিসরের জীবনে এমন চুরি করেই বেড়িয়েছে তারা। তাদের অনেকে চেনে ‘ক্রিমিনাল কাপল’ বা সন্ত্রাসী দম্পতি হিসেবে। তাদের ঘিরে অনেক মিথ ছড়িয়ে ছিল ত্রিশের দশকে। কিন্তু তাদের প্রণয়ের গল্পটি মোটেই মিথ নয়। সেই প্রেমের পরতে পরতে মেশানো রয়েছে রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা। সুখী ও সচ্ছল জীবনযাপনের জন্যই তারা চুরি শুরু করে। একপর্যায়ে অপরাধের সঙ্গে মিশে গিয়ে শুরু করে খুন। সন্ত্রাসীদের দুনিয়ায় তারা দুজন স্থানীয় গডফাদার হয়ে ওঠে। দামি গাড়িতে চড়ত, দামি ফ্যাশনেবল কাপড় পরে বিভিন্ন পার্টিতে বেড়াত এই যুগল। সবাই জানত তারা চোর, খুনি তবে এতে যেন তাদের জনপ্রিয়তা বরং বেড়েছিল। দুজনের সম্পর্কের রসায়নও ছিল চমৎকার। কোনো ধরনের বিপৎকেই তারা তোয়াক্কা করত না। পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে দৌড়ে বেড়ানোই যেন তাদের নেশা ছিল। গ্লামারাস ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত এই যুগলের প্রেমকাহিনী গল্পকেও হার মানায়। আইনের চোখে মারাত্মক সন্ত্রাসীর তকমা গায়ে জড়িয়ে রীতিমতো জনপ্রিয় তারকাদের মতো জীবনযাপন করত তারা। তাদের প্রেমের শুরুটাই ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। ক্লাইড ব্যারো তখন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একজন। তার সঙ্গে হঠাৎ পরিচয় হয় বনি পার্কারের। কিশোরী বয়সী বনিকে দেখে মনে ধরে যায় ক্লাইডের। তার ছন্নছাড়া আর পুলিশের তাড়া খাওয়া জীবনের সঙ্গে কে নিজের জীবন বাঁধতে চাইবে? এ প্রশ্ন নিয়েই ছুটে বেড়াত ক্লাইড। ওদিকে বনি পার্কারের অতীতেও রয়েছে দুঃখের ছোঁয়া। ১৬ বছর বয়সে সে প্রেমে পড়েছিল তার সহপাঠী রয় থর্টনের। সুদর্শন পুরুষ থর্টনকে সে এতটাই ভালোবেসেছিল যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পরানো বিয়ের আংটি একদিনের জন্যও খোলেনি বনি পার্কার। সে বিয়ে নিয়ে খুব সন্তুষ্ট ছিল তাও নয়। বনি পার্কার কিছুটা খেয়ালি স্বভাবের ছিল। সে কারণেই তার দুরন্তপনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি তার স্বামী। এই দূরত্ব থাকার পরও সে ডিভোর্সের পথ ধরেনি কখনো। তার স্ত্রী তার থেকে দূরে সরে যায়। পরিচয় ঘটে ক্লাইডের সঙ্গে। ক্লাইডের সঙ্গ পেয়ে বেপরোয়া জীবনকেই বেছে নেয় বনি। চুরি, ব্যাংক লুট, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি আর খুনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে তারা। ধীরে ধীরে ক্লাইডের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। ক্লাইড এ অন্যরকম নারীকে তার জীবনের অংশ হিসেবেই গ্রহণ করে। দুজনে গড়ে তোলে সন্ত্রাসীর অন্য এক রাজ্য। এ রাজ্যে তারা দুজনেই রাজা-রানী। কিন্তু ব্যাংক লুট আর খুনের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মানুষের মুখে মুখে তাদের নাম। পুলিশ তাদের হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। এসবের মধ্যেই চলছিল তাদের জীবন। এই যুগলকে নিয়ে অনেক মিথ রয়েছে। যার কিছু কিছু সত্যি হলেও সবটা নয়। যেমন, তাদের সম্পর্কে বলা হয় কেউ অবাধ্য হলেই তারা খুন করত। আসলে বাস্তবতা বলে তারা খুন করেছে খুবই কম এবং এ খুনগুলো তারা প্রয়োজনের তাগিদেই করেছে। নয়তো নিজেদের প্রাণই হারাতে হতো। উল্টো তারা অনেক নিরপরাধ মানুষকে ছেড়ে দিয়েছে। বনি পার্কারকে নিয়ে মিথ রয়েছে সে বহু পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল, সে মদ্যপ ও একের পর এক সিগারেট পান করত। এসবই ভুল। তাদের জীবনী নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকেই একমত হয়েছেন বনি পার্কার সম্পর্কের ব্যাপারে উদাসীন ছিল। বরং ব্যাংক লুট ও চুরি করাতেই সে ভিন্নরকম উত্তেজনা অনুভব করত। শুধু টাকার লোভে নয় জীবনে রোমাঞ্চ যোগ করতেই সে এসবে জড়িয়ে পড়েছিল। তাদের ঘিরে আরেকটি বাস্তবতা হলো তারা কখনই কুখ্যাতি লাভ করতে চায়নি। তারা খ্যাতিও চায়নি। সফল ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনকে তারা প্রাধান্য দিত। কিন্তু টাকা রোজগারের জন্য তারা ভুল পথটিই বেছে নিয়েছিল। তারা গিটার বাজাতে খুব পছন্দ করত। খোলা প্রান্তরে গিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইত। কে বুঝত এই মাত্র ব্যাংক থেকে হাজার হাজার ডলার লুট করে এসেছে তারা! বিশেষ করে বনি পার্কারের গানের গলা নিয়ে আলাদা করে বলতেই হয়। স্কুল থেকেই সে গানে বিশেষ পারদর্শী ছিল। টেক্সাসের টেলেন্ট হান্টিংয়ে সে উঠে এসেছিল খ্যাতিমান গায়িকা হিসেবে। সে দেখতেও চমৎকার, মিষ্টি মেয়ে ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছে ছিল সিনেমার রুপালি পর্দায় নিজেকে দেখার। ক্লাইডও বনির এই স্বপ্ন পূরণের পথ ধরেই এগিয়ে নিয়েছিল। সন্ত্রাসী হয়ে উঠলেও অভিজাত সমাজে বনি পার্কারকে সে উপস্থাপন করত শিল্পী হিসেবেই। যেখানেই যেত ক্লাইড তার সঙ্গে প্রিয় গিটারটি নিতে ভুল করত না। তারা সিনেমার তারকা হতে পারলেও সন্ত্রাসী হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করে। তাদের অভিজাত ও বিলাসী জীবন দেখে লোকে তাদের তারকাতুল্য খ্যাতি দিয়েছিল। বনি পার্কার আর ক্লাইডের কথা উঠলেই সবার চোখে ব্যাংক লুটেরাদের দৃশ্য ভেসে উঠলেই এ নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের মিথ ছড়িয়ে পড়ে। অথচ বাস্তবতা বলে তারা মাত্র ১৫টির মতো ব্যাংক লুটের সঙ্গে জড়িত। বড় বড় ব্যাংক লুটের ঘটনায় ক্লাইড আর বনিকে সাহায্য করত আরেকজন লুটেরা যার নাম ছিল রেমন্ড হ্যামিল্টন। বনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গাড়ি চালিয়ে তাদের পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করত। আর লুটে যাওয়া টাকার ভাগ পেত ক্লাইড। তাদের জীবনে সচ্ছলতা আর খ্যাতি ছাড়াও আরেকটি জিনিস মিলেমিশে ছিল তা হলো, বিপদ। পুলিশের তাড়া ছিল তাদের জীবনভর। সবার সামনে তারা আসতে পারত না। গোপনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা কিছু সময়ের জন্য উপস্থিত থাকত আর সেখানে উপস্থিত সবাই তাদের কাছে ছুটে যেত। ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরা সব সময়ই তাদের খুঁজে বেড়াত। তাদের টাকা পয়সা উৎস ছিল ব্যাংক লুট, দোকান লুট আর গাড়ি চুরি। এ ছাড়া চাঁদাবাজিতেও তারা কুখ্যাত ছিল। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা বড় অঙ্কের চাঁদা তুলত। লুট করা গাড়ি বিক্রি করেও তারা বেশ ভালোই আয় করত। এসব ছাড়াও তাদের অপরাধ কর্মের মধ্যে ছিল খুন। বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনার ব্যাপারে সরাসরি তাদের নাম জড়িত থাকায় পুলিশের কাছে তারা শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়। সব খুনের ঘটনার জন্য মানুষের কাছে তারা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

 

অপরাধী দুজন

ক্লাইড ব্যারো

তার খ্যাতির চেয়ে কুখ্যাতি ছিল বেশি। ব্যাংক লুট, দোকান লুট আর খুন ছিল তার নেশা ও পেশা। প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক বনে যায় সে। বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত ছিল। তার জীবনে বনি পার্কার আসার পর থেকেই দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। বনি পার্কারের সঙ্গে প্রেমের পর থেকেই রীতিমতো তারকা অপরাধী যুগল হিসেবে অভিজাত সমাজে চলাফেরা শুরু করে।

 

বনি পার্কার

সুন্দরী নারী। অসম্ভব মেধাবী শিল্পী ছিল ছোটবেলায়। কিন্তু রোমাঞ্চপ্রিয় হওয়ায় ব্যক্তিগত জীবনে ছিল কিছুটা খেয়ালি। ১৯৩০ সালে তার দেখা হয় ক্লাইড ব্যারোর সঙ্গে। তার হাত ধরেই অপরাধের জগতে প্রবেশ করে সে। ক্লাইডের সঙ্গে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা ছাড়াও ব্যাংক লুটে সহযোগী ছিল সে। ত্রিশের দশকে অন্যতম শীর্ষ অপরাধী হিসেবে নাম লেখায় সে।

সর্বশেষ খবর