বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
তানভীর আহমেদ

বিভক্ত আম্বানি পরিবারের কত সম্পদ

রিলায়েন্স গড়েছিলেন ধিরুভাই আম্বানি। তার দুই ছেলে মুকেশ আম্বানি ও অনিল আম্বানি। বাবার মৃত্যুর পর ব্যবসার মালিকানা নিয়ে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন দুই ভাই। আদালত পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি। মায়ের মধ্যস্থতায় দুই ভাই ভাগ করে নেন সম্পদের মালিকানা। অনিল আম্বানির দাপুটে শুরু হলেও কয়েক বছরের মাথায় ব্যবসায় ধস। বড় লোকসানে পড়ে অনিল একের পর এক ব্যবসা বিক্রি করতে বাধ্য হন। ব্যবসা বুঝতেন মুকেশ। ভাইকে পেছনে ফেলেছেন বহু আগে। টাকার পাহাড় গড়ে তুলে এখন ভারতের শীর্ষ ধনী তিনি...

বিভক্ত আম্বানি পরিবারের কত সম্পদ

মুকেশ আম্বানি

১০৫.১ বিলিয়ন ডলার (বর্তমান)

টাকার পাহাড় গড়ছেন মুকেশ আম্বানি

মা কোকিলাবেন সম্পত্তি ভাগ করে তেল শোধনাগার ও পেট্রোকেমিক্যাল ব্যবসা মুকেশ আম্বানির হাতে তুলে দেন। একই সঙ্গে দুই ভাই একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বলা হয়, মুকেশ টেলিকম ব্যবসায় পা রাখবেন না, অন্যদিকে অনিল তেল শোধনাগার ও পেট্রোকেমিক্যাল থেকে দূরে থাকবেন। ২০১০ সালে এ চুক্তি শেষ হয়। তারপরই টেলিকম সেক্টরে প্রবেশ করেন মুকেশ আম্বানি। প্রথম সাত বছরে ২.৫ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি। বাজারে আসে রিলায়েন্স জিও। ঘুরে যায় টেলিকমিউনিকেশন ব্যবসার চিত্র। টাকার পাহাড় গড়ে তুলতে শুরু করেন তিনি। এরপরই এক ধাক্কায় ভারত তথা এশিয়ার ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় জায়গা করে নেন। আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে রিলায়েন্স গ্রুপের ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরির পেছনের কারিগরও তিনি। এখন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান তিনি। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার্স ইনডেক্স অনুসারে, মুকেশ আম্বানির সম্পদের পরিমাণ ১০৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ভারতীয় টাকায় তার সম্পদের মূল্য ৮,৫৫,৭৩০ কোটি টাকা। বর্তমানে মোট সম্পদের হিসাবে এখন তিনি ১০৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক। ভারতের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি তিনি।

 

যেভাবে বিরোধ দুই ভাইয়ে

ধিরুভাই আম্বানির মৃত্যুর পর বিরোধ শুরু হয় দুই ভাইয়ের মধ্যে। ধিরু ভাইয়ের মৃত্যুর দুই বছরের মধ্যে দুই ভাইয়ের তিক্ততা প্রকাশ্যে আসে। এই সমস্যার সমাধান করেন তার মা কোকিলাবেন।

মুকেশ আম্বানি ও অনিল আম্বানির মধ্যে ব্যবসায়িক নানা সিদ্ধান্তে মতবিরোধের খবর ফলাও করে প্রচার হয় গণমাধ্যমে। ব্যবসায়িক অস্থিরতার পেছনে সম্পদের ভাগাভাগি ও উত্তরাধিকার প্রাপ্তির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। নানা দিকে তখন ব্যবসা ছড়িয়ে আছে আম্বানি পরিবারের। প্রশ্ন ওঠে রিলায়েন্স কোম্পানির মালিকানা কার। এ যুদ্ধ শেষ হয় তাদের মায়ের হস্তক্ষেপে। খবর পাওয়া যায় দুই ভাইয়ের মধ্যে মা একটি মধ্যস্থতা করে দিয়েছেন। মধ্যস্থতার মাধ্যমে অনিল রিলায়েন্সের টেলিকমিউনিকেশন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বিনোদনের মালিকানা পান।

মুকেশ পান কোম্পানির তেল, টেক্সটাইল এবং সব শোধনাগারের ব্যবসা।

 

অনিল আম্বানি

২.৫ বিলিয়ন ডলার (ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)

স্ত্রীর গয়না বেঁচে সংসার চালাতে হয়েছিল

রিলায়েন্সের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের পর মুকেশ আম্বানির সঙ্গে তার ভাই অনিল আম্বানির দূরত্ব বেড়ে যায়। দেশে ও দেশের বাইরে মুকেশ আম্বানির ব্যবসায়িক নেতৃত্বের আলাদা সুনাম ছিল। অন্যদিকে ব্যবসা ভাগাভাগির পর অনিল আম্বানি বেশ বেকায়দায় পড়ে যান। একসময় মুকেশ আম্বানির থেকেও বেশি ধনী ছিলেন অনিল আম্বানি। তার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের এক হিসাবে দেখা যায়, তার সে সম্পদ নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২.৫ বিলিয়ন ডলারে। তার মৃত্যুর পর অনিল টেলিকম, ফিন্যান্স ও অ্যানার্জি ইউনিট হাতে পান। প্রথম দিকে অনিলের ব্যবসা ভালো চললেও ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দায় তিনি ক্ষতির সম্মুখীন হন। দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানি এমটিএনএ সঙ্গে চুক্তিতে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেন আর তাতেই তিনি ক্ষতির মুখে পড়েন। তার পাশাপাশি চীনা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও তিনি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। অনিলের মোট ক্ষতি হয় ৪০ বিলিয়ন ডলার। এরপর ব্যবসা বাঁচাতে নিয়েছেন বড় অঙ্কের ঋণ। সেসব আর পরিশোধ করতে পারেননি। ২০২০ সালে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। সংসার চালাতে ও মামলার টাকা পরিশোধ করতে স্ত্রীর গয়না পর্যন্ত বিক্রি করার কথা জানান তিনি।

 

মুকেশ আম্বানির অঢেল সম্পদের উত্তরাধিকার যারা

মুকেশ আম্বানির তিন সন্তান। দুই যমজ সন্তান ইশা ও আকাশ আর অনন্ত। মুকেশ আম্বানির এই তিন সন্তানের হাতেই যাচ্ছে শত শত কোটি ডলারের সম্পদের মালিকানা। ইশা ও আকাশের বয়স এখন ৩২, আর অনন্তের বয়স ২৯। ইশা ও আকাশ যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। সম্পদের উত্তরাধিকার নকশা অনুযায়ী, আকাশ ও ইশা সামলাবেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের টেলিকমিউনিকেশন ও রিটেইল ব্যবসা। আর ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানি সামলাবেন জ্বালানি ব্যবসা। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের কমিটির সভায় অংশগ্রহণের জন্য ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানির তিন সন্তান সম্মানী পেলেও আলাদা করে কোনো বেতন তাদের দেওয়া হবে না। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে মুকেশ আম্বানি নিজেও অবশ্য বেতন নেওয়া বন্ধ রেখেছেন।

আকাশ আম্বানি :  আকাশ আম্বানি কলেজে পড়া শেষ করার পর ২০১৪ সালে রিলায়েন্স গ্রুপের টেলিকম ইউনিট রিলায়েন্স জিওর লিডারশিপ টিমে যোগ দেন। তিনি এখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের ধনী ক্রিকেট দল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স-এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন।

অনন্ত আম্বানি : মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত জড়িত আছেন রিলায়েন্সের জ্বালানি-সংক্রান্ত ব্যবসায়। এর মধ্যে আছে ফসিলজাত জ্বালানি থেকে শুরু করে সৌরশক্তি প্যানেল তৈরির ব্যবসাও। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট অনন্ত তার মায়ের সঙ্গে রিলায়েন্স চ্যারিটির বোর্ডেও আছেন।

 

এশিয়ার শীর্ষ ধনী পরিবার আম্বানির

মুকেশ আম্বানি ও অনিল আম্বানি। অনেকে বলেন আম্বানি ব্রাদার্স। সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার পর অনিল আম্বানির কপাল পুড়লেও এশিয়ার শীর্ষ ধনী পরিবারের তকমা আম্বানি পরিবারের কাছেই রয়েছে। গত বছর আম্বানি পরিবারের সম্পদ ৮৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। অনিল আম্বানির সঙ্গে মুকেশ আম্বানির ব্যবসার আলাদা হয়ে যাওয়ার পর মুকেশ আম্বানির পরিবার এককভাগে সম্পদশালী পরিবার হয়ে ওঠে। এ পরিবারের অঢেল সম্পদের ইতিহাস জানতে প্রথমেই বলতে হয় ধিরুভাই আম্বানির কথা। তিনি আম্বানি ব্রাদার্সের পিতা। স্বল্পশিক্ষিত এই ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধি দিয়েই গড়ে তোলেন ব্যবসা। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের স্বপ্ন দেখেছিলেন ধিরাজলাল হীরাচাঁদ আম্বানি। তার বাবা হীরাচাঁদ ছিলেন সামান্য স্কুল শিক্ষক। ধিরুভাই ছোট বেলাতেই বুঝতেন বাবার সামান্য আয় দিয়ে সংসার চলছে কোনো মতে। মাধ্যমিক পাসের পর পড়াশোনার ইতি টানলেন। তখন তার বড় ভাই রামনিকলাল আম্বানি কাজ করতেন ইয়েমেনের বন্দর নগরী এডেনে। ধিরুভাই চলে গেলেন এডেন। সেখানে গিয়ে এ. বেসে অ্যান্ড কোং. (কোম্পানি)-তে মাত্র ৩০০ রুপির বিনিময়ে কাজ নিলেন। এ কোম্পানিতে চাকরি করে তেলের ব্যবসা ভালোভাবে বুঝে গিয়েছিলেন। কর্মক্ষেত্র ছিল একটি পেট্রল স্টেশন, কাজ ছিল গ্যাস ভরা ও অর্থ আদায় করা। একপর্যায়ে বিক্রয় ব্যবস্থাপকে উন্নীত হন। এর মধ্যে আরবি ভাষাটাও রপ্ত করে নেন ভালোভাবেই। বেতন বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১০০ রুপিতে। বিয়ে করলেন কোকিলাকে। ধিরুভাইয়ের চার সন্তান। দুই ছেলে মুকেশ আম্বানি এবং অনিল আম্বানি, দুই মেয়ে নিনা কথারি এবং দীপ্তি সালগাকোর। ১৯৬২ সালে ধিরুভাই ভারতে চলে আসেন। প্রতিষ্ঠা করেন রিলায়েন্স কোম্পানি। প্রথম দিকে ইয়েমেন থেকে মসলা আমদানি করতেন। পরবর্তীতে তারা সুতার ব্যবসা শুরু করেন। ধিরুভাই আম্বানির বড় ছেলে মুকেশ আম্বানি। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের স্টানফোর্ড থেকে এমবিএ করেন। ১৯৮০ সালে পড়াশোনা শেষ করার পর বাবা তাকে দেশে ফিরতে বলেন এবং একটি পলেস্টার কারখানার দায়িত্ব দেন। মুকেশের নেতৃত্বগুণে কোম্পানির ব্যবসা আরও বড় হতে শুরু করে। পরবর্তী বছরগুলোতে রিলায়েন্স পেট্রোকেমিক্যাল, পেট্রোলিয়াম পরিশুদ্ধকরণ, টেলিকমিউনিকেশন, বিনোদন, সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এবং তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ইত্যাদি ব্যবসায় নিজেদের সম্প্রসারিত করেন। ব্যবসা ছড়িয়ে দেন মুকেশ আম্বানি। আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে রিলায়েন্স গ্রুপের ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি হয়। আম্বানিদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়।

 

মুকেশ আম্বানির চেয়েও বেশি ধনী ছিলেন অনিল আম্বানি

রিলায়েন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান অনিল আম্বানি। তার হাতে রয়েছে রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস, রিলায়েন্স ক্যাপিটাল, রিলায়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রিলায়েন্স পাওয়ার, রিলায়েন্স ডিফেন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড এবং রিলায়েন্স ডিফেন্স টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড। একসময় অনিল আম্বানির ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য মুকেশ আম্বানিকে চ্যালেঞ্জ জানাত। ২০০৬ সালে বাবার মৃত্যুর পরও আম্বানি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে।

ফোর্বস অনুসারে, ভারতে অনিল আম্বানি তখন স্টিল টাইকুন লক্ষ্মী মিত্তাল এবং আজিম প্রেমজির পরে তৃতীয় ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ২০০৭ সালে অনিলের মোট সম্পদ ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। অন্যদিকে সম্পদের হিসাবে এগিয়ে যান মুকেশ। ব্যবসায়িক মন্দায় পড়েন অনিল। লোকসান ঠেকাতে না পেরে একের পর এক ব্যবসার শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি। জড়িয়ে যান মামলায়। একটা সময় ছিল যখন অনিল আম্বানি ছিলেন বিন্ডির ষষ্ঠ ধনী শিল্পপতি কিন্তু আজ তিনি দেউলিয়া হয়ে গেছেন। পড়েছেন ব্যাংকের ভারী ঋণের বোঝার নিচে। অনিল আম্বানি প্রায় ৪৯ বার খেলাপি হয়েছেন। এক ভাই যখন এশিয়ার সবচেয়ে ধনী শিল্পপতি আর অন্য ভাই তার দেউলিয়া কোম্পানিগুলোর ঋণের বোঝা বহন করছেন।

 

মেয়ের হাতেই ব্যবসায়িক ভবিষ্যৎ দেখছেন মুকেশ

এরই মধ্যে রিলায়েন্স কোম্পানিতে তৃতীয় প্রজন্মের পারিবারিক নেতৃত্বের সূচনা ঘটেছে। শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন সাপেক্ষে মুকেশ আম্বানির সন্তানরা পরিচালক মন্ড -লীতে যোগ দেন। বোর্ডে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আকাশ আম্বানি, অনন্ত আম্বানি ও ইশা আম্বানিকে। শেয়ারহোল্ডাররা ইশা আম্বানি, আকাশ আম্বানি এবং অনন্ত আম্বানিকে নন-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন করেন। তেল, টেলিকম, কেমিক্যালস, প্রযুক্তি, ফ্যাশন থেকে শুরু করে খাদ্যপণ্যসহ বহু দিকে বিস্তৃত রিলায়েন্সের ব্যবসা। বৈশ্বিক ফার্মের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সাধারণ বীমা ও স্বাস্থ্য বীমার ব্যবসায় প্রবেশের চেষ্টা করছে তারা। এ ছাড়া প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি খাত নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে এই গ্রুপের। সম্পদের ভাগাভাগির পর সবার নজর কাড়েন ইশা আম্বানি। ইশা দেশটির পারিবারিক ব্যবসার জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকা নতুন প্রজন্মের নারীদের একজন বলেই বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছেন। রিলায়েন্সের প্রধান ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ইশার এ উত্থান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাকে সিনিয়র নেতৃত্বের ভূমিকা দেওয়া হয়েছে, যেখানে এ পরিবারের অন্য নারীরা এতদিন পর্যন্ত এত বড় ভূমিকা পাননি। ২০২১ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে ‘এয়ারেস অন-ডিউটি’ বলে আখ্যায়িত করে এবং ভারতের ক্ষমতাধর নারীদের মধ্যে ২১ নম্বরে তাকে স্থান দেয়। ইতোমধ্যেই তাদের কোম্পানির রিটেইল, ই-কমার্স ও লাক্সারি-সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলোকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে। বলা হয়, ফ্যাশনের ক্ষেত্রে ই-কমার্সের মাধ্যমে এই ফার্মের ক্রম-প্রসারমান উপস্থিতি, শীর্ষস্থানীয় কিছু আন্তর্জাতিক বিলাসদ্রব্যের ব্র্যান্ডের সঙ্গে অংশীদারিত্বের পেছনেও তিনি আছেন। রিলায়েন্স রিটেলের দায়িত্বে রয়েছেন মুকেশ কন্যা ইশা। খুচরা ব্যবসায় তার নেতৃত্ব উল্লেখযোগ্য। ঈশা দায়িত্ব নেওয়ার পর এই ব্যবসার অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয়েছে। ২ লাখেরও বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করেছে রিলায়্যান্স রিটেল।

 

যেভাবে অনিল আম্বানির ব্যবসায় ধস নেমেছিল

মুকেশ আম্বানির ‘রিলায়েন্স জিও’ ভারতের পুরো বাজার দখল করে ফেলে।  অনেক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেউলিয়া হয়ে যায় অনিলের রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্সও

ব্যবসা ভাগাভাগির সময়ই এগিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন অনিল আম্বানি। মুকেশের সঙ্গে তার মতবিরোধের অন্যতম কারণ ছিল ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে তিনি কিছুটা জেদি হওয়াটাকে ভালো মনে করতেন। অন্যদিকে মুকেশের দারুণ নেতৃত্বগুণ ব্যবসায়িক উন্নতিতে সহায়ক ছিল। অনিল আম্বানি তাই ব্যবসার নতুন সেক্টরগুলোকে নিজের হাতে রাখতে চাইলেন। তিনি অ্যাডল্যাবস কিনে ফেলেন। এটি পরে ভারত ও ভারতের বাইরে প্রায় ৭০০টি আইম্যাক্স বিগ সিনেমা স্ক্রিন তৈরি করে। ভেবেছিলেন এ ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি করবেন। যা পুরো ভুল প্রমাণিত হয়। কারণ আইম্যাক্স বিগ সিনেমা স্ক্রিন ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে দর্শক টানতে পারেনি। শোবিজ অঙ্গনের তারকা ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করেন অনিল। সেটা কাজে লাগিয়েই মুকেশের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে মামলা ঠুকে দেন। কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্তে জয় পান মুকেশ। অনিলের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান ছিল রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স। সেখানে তারা ব্যবহার করতেন সিডিএমএ টেকনোলজি।  কিন্তু অন্যান্য মোবাইল ফোন অপারেটররা হুট করেই আনল ব্যয়বহুল জিএসএম প্রযুক্তি। জিএসএমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়- ফোরজি ও ফাইভজিতেও বেশ ভালো সার্ভিস দেওয়া যায়। পরবর্তীতে ভারতে যখন ফোরজি-ফাইভজি এলো, রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্সের ব্যবহারকারী একদম কমে তলানিতে এসে ঠেকল। চাপে পড়লেন অনিল আম্বানি। তখনই মাঠে এলো মুকেশ আম্বানির ‘রিলায়েন্স জিও’। জিও ভারতের পুরো বাজার দখল করে ফেলে। অনেক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেউলিয়া হয়ে যায় রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্সও। অনিল আম্বানি ব্যবসায়িক ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় সংকটের মুখে পড়েন। আইম্যাক্স বিগ সিনেমাকে তিনি তখন ‘কার্নিভ্যাল সিনেমা’র কাছে বিক্রি করে দেন। বিভিন্ন ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্টে টাকা ইনভেস্ট করে লসের মুখে পড়েন। ডিফেন্স সেক্টরে টাকা  ঢেলেও লসের মুখে পড়েন তিনি। এদিকে ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে তার। ঋণ শোধ করতে আস্তে আস্তে নিজের প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করা শুরু করেন তিনি। এভাবেই ধাক্কা খেতে খেতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অর্থবিত্তের সবটাই হারান তিনি। অনিল আম্বানির রিলায়েন্স টেলিকমিউনিকেশন্সের কাছে এরিকসনের পাওনা ছিল ৫৫০ কোটি রুপি। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সাফ জানিয়ে দিয়েছিল এই টাকা পরিশোধ করতে না পারলে অনিল আম্বানিকে যেতে হবে কারাগারে। এদিকে এই টাকা পরিশোধের সামর্থ্য ছিল না অনিলের। ভাইকে রক্ষা করেন মুকেশ আম্বানি। নিজে ৫৫০ কোটি রুপি দিয়ে দেন এরিকসনকে। জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচেন অনিল। ব্যাংক ঋণের জালে বারবার আদালতের মুখোমুখি হতে হয় অনিলকে। ভিডিও কলের মাধ্যমে লন্ডনের এক আদালতের শুনানিতে হাজির থাকতে হয়েছিল তাকে। তিনটি চীনা ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় তিনি বড় ধরনের বিপদে পড়েন। রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের কাছে ৭০ কোটি ডলার পাওনা আদায়ের জন্য মামলাটি করে এই ব্যাংকগুলো। আদালতের জেরার সময়ে অনিল আম্বানি জানান তিনি দেউলিয়া হয়ে গেছেন।

 

মুকেশের বিন্ডির সবচেয়ে দামি বাড়ি, বাবার তৈরি বাড়িতে ঠাঁই অনিলের

এ যেন মুকেশ প্রাসাদ! বাড়িটির নাম আন্তিলা। ‘আন্তিলা’ ভবনটি মোট ৪ লাখ বর্গফুট জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুম্বাইয়ের অভিজাত এলাকায়। আন্তিলায় ফ্লোর সংখ্যা ২৭। সাত বছরের নির্মাণ কাজে ব্যয় করা হয়েছে ১০০ কোটি ডলার। বাড়িটির উচ্চতা ১৭৩.১২ মিটার, যা একটি সাধারণ ৬০ তলা দালানের উচ্চতার সমান। প্রথম ৬ তলা নির্ধারণ করা হয়েছে কার পার্কিং স্পেস হিসেবে। আমদানি করা ১৬৮টি লাক্সারি গাড়ি ব্যবহার হয় শুধু পরিবারের প্রয়োজনে। অষ্টম তলায় রয়েছে একটি বিশাল বিনোদন কেন্দ্র, এখানে নির্মাণ করা হয়েছে ৫০ জনের আসনক্ষমতা নিয়ে একটি মিনি থিয়েটার। নবম তলা রিফিউজ ফ্লোর, জরুরি প্রয়োজনে উদ্ধার কাজের জন্য এটি ব্যবহার হবে। তার ওপরের দুটি ফ্লোর স্বাস্থ্য কেন্দ্র। একটিতে রয়েছে সুইমিং পুলসহ খেলাধুলার সব সরঞ্জাম। বাড়ির শীর্ষে দুটি ফ্লোরের মধ্যে একটি পরিবারের সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এবং তার পরেরটি  হেলিপ্যাডের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হিসেবে ব্যবহার হয়। এই বাড়ি ও বাড়ির মানুষজনের দেখাশোনার জন্য রয়েছে ৬০০ কর্মী। অন্যদিকে অনিল আম্বানি থাকেন বাবার তৈরি করা বাড়িতে। এ বাড়িতে সুইমিং পুল, জিম, হেলিপ্যাড, পার্কিং স্পেস, গাড়ির সংগ্রহ প্রদর্শনের জন্য বড় লাউঞ্জ এলাকা রয়েছে। অনিল আম্বানির বাড়ির বারান্দা থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায়। এটি বিলাসবহুল আকাশচুম্বী ১৭ তলা বিল্ডিং। ভবনটির উচ্চতা প্রায় ৬৬ মিটার। অনিল অম্বানি মূলত তার বাড়ির বিল্ডিংয়ের উচ্চতা ১৫০ মিটার বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে নির্মাণ কর্তৃপক্ষ এটির উচ্চতা বাড়াতে বাধা দেয়।

 

সর্বশেষ খবর