রবিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
ভিন্ন আয়োজন

শহর ঘেঁষে বিখ্যাত নদী

শহর ঘেঁষে বিখ্যাত নদী

নদী ও মানুষের মাঝে গভীর মিতালি! নদীর তীরেই যুগে যুগে গড়ে উঠেছে সভ্যতা। আপন গতিতে ছুটে চলা নদীর পানির ওপর নির্ভর  করেছে তাদের জীবিকা, সংস্কৃতি, দর্শন ও জীবনধারা...

 

টেমস নদীর তীরে সিটি অব লন্ডন

ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবাহিত প্রধান নদী টেমস। কেবল লন্ডন নয়, আরও বেশ কিছু শহরের বুক ছুঁয়ে গেছে টেমস। এসব শহরের তালিকায় রয়েছে অক্সফোর্ড সিটি, রেডিং ও উইন্ডসর সিটি। এ নদী ঘিরে গড়ে ওঠে জনবসতি, আধুনিক শহর আর অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন ও অর্থনৈতিক স্থাপনা। নদীবিধৌত শহরগুলোর পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা দাপুটে টেমসের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। টেমসের ঝিরিঝিরি বাতাসে মিশে থাকে এক জাদুময় মোহ। আর তা গায়ে মাখতেই হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ছুটে আসে পর্যটক। এর উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ-মধ্য ইংল্যান্ডের অপূর্ব কটসওল্ড গিরিশ্রেণির চারটি জলপ্রবাহ। এটা পুব দিকে ৩৫০ কিলোমিটার পথ এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। যাত্রাপথে এর সঙ্গে আরও অন্যান্য নদী মিলিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নদীটি প্রায় ২৯ কিলোমিটার প্রশস্ত মোহনার মধ্য দিয়ে উত্তর সাগরে গিয়ে পড়েছে। এটি ইংরেজদের ইতিহাস প্রভাবিত করেছে। প্রায় ৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার ইংল্যান্ডে রোমীয়দের প্রথম আক্রমণে নেতৃত্ব দেন। পরের বছর তিনি যখন আরও এগিয়ে যাবেন পরিকল্পনা করলেন তখন একটি নদী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার নাম দেন টেমেসিস বা টেমস। সময়ের পালাবদলে ৯০ বছর পর এসে রোমীয় সম্রাট ক্লডিয়াস সেই দেশ নিজের অধিকারে নিয়ে নেন। তখন টেমস নদীর দুই ধারেই জলাভূমি ছিল। মোহনা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে রোমীয় সেনাবাহিনী একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করে। নদীর উত্তর তীরে একটি বন্দরও তৈরি করে। বন্দরের নাম দেয় লনডিনিয়াম; যা পরে লন্ডন নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তী ৪০০ বছর রোমীয়রা ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বিস্তার করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে বিলাসদ্রব্য ও লেবানন থেকে কাঠ আমদানি করে এ বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া টেমস নদী দিয়েই তারা দেশের মধ্যভাগ থেকে লন্ডনে মালপত্র নিয়ে আসত। ফলে লন্ডন শহর শিগগিরই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

সিন নদীর পাশে প্যারিস

বিখ্যাত সিন নদীর পাশে প্রেমের শহর প্যারিস। ফ্রান্সের রাজধানী এবং ইউরোপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহর। প্রায় ২ হাজার বছর আগে রোমানরা রাজত্ব করত এ অঞ্চলে। ফলে আজও শহরজুড়ে রোমানদের একোয়াডাট্র। গোটা শহরের পানির সরবরাহ আসে এখান থেকেই। এসবের দুই পাশে ফুলের বাগানে রকমারী ফুলের বাহার। প্যারিসের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীর মোহনাটি প্রায় ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং এর দুই পাশে অবস্থিত ল্যা আভ্র এবং ওঁফ্লর বন্দর। নদীটির দৈর্ঘ্য ৭৭৬ কিলোমিটার। মোহনা থেকে ৫৬০ কিলোমিটার উজানে বার-সুর-সেন শহর পর্যন্ত নৌপরিবহনের উপযোগী। নদীর পাশেই রয়েছে আইফেল টাওয়ার এবং লোকেদের মুখে মুখে চলে আলেকজান্দ্রার ঝুলন্ত সেতুর গল্প। বিখ্যাত সেতুটি সিন নদীর দুই তীর এক করেছে এবং পাশে রয়েছে অসংখ্য নান্দনিক স্থাপত্য।

নীল নদ ঘেঁষে প্রচীন মিসর

প্রাচীন সভ্যতার অনন্য নিদর্শন মিসর। এর বুক চিরে বয়ে চলেছে নীল নদ। আজও মিসরের সব প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন নীল নদের তীরেই দেখা যায়। আফ্রিকা মহাদেশে সবচেয়ে বড় এ নদটির দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ১৩২ মাইল। নদটি শ্বেত ও নীলাভ নামক দুটি উপনদে বিভক্ত হয়ে ১১টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। উপনদ দুটি সুদানের রাজধানী খার্তুমের কাছে মিলিত হয়েছে এবং পরে মিসরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মোহনার কাছে বিশাল ব-দ্বীপ সৃষ্টি করে যা ভূমধ্যসাগরে মিশেছে। নীল নদের উৎপত্তি নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত। কেউ মনে করেন লেক ভিক্টোরিয়া আসলে এর উৎপত্তিস্থল। কারণ লেক ভিক্টোরিয়া থেকে ছোট উপনদী তৈরি হয়ে নীল নদে মিশেছে। অনেকে মনে করেন, সবচেয়ে বড় উপনদীগুলোর উৎপত্তিস্থল কাগেরা নদী আসলে নীল নদেরই উৎসস্থল। প্রাচীন মিসরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যাওয়া মোহনার কাছে বিশাল ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে, যা ভূমধ্যসাগরে মিশেছে।

টাইবার নদী ঘেঁষে রোম নগরী

ইতালির সবচেয়ে বড় নদী টাইবার; যা রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির উত্থান, শাসন ও পতন তথা রোমের নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও বয়ে চলেছে। টাইবার যদিও রোমের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী, কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের সঙ্গে এর নাম এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে রোমে এলে টাইবারকে উপেক্ষা করা যায় না। রোমানরা সুড়ঙ্গ করে এ নদীর পানি শহরের ভিতরে নিয়ে যেত। এমনকি রোমান সময়ে বন্দিদের মৃত্যুদ- দিলে সেই মৃতদেহ এ টাইবারেই ভাসিয়ে দিত। এমিলিয়া-রোমানার অ্যাপেনাইন পর্বতমালা টাইবার নদীর উৎপত্তিস্থল; যা তোসকানা, উম্ব্রিয়া ও লাৎসিওর মধ্য দিয়ে ৪০৬ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে আনিয়েনে নদীর সঙ্গে মিলে অস্ট্রিয়া ও ফিউমিচিনোর মাঝামাঝি স্থানে তিররেনীয় সাগরে মিলিত হয়। নদীটি রোমের প্রধান পানিচক্র হিসেবে বেশ পরিচিত।

মস্কোভা নদীর পাশে মস্কো

রাশিয়ার রাজধানী শহর মস্কো। যে শহর বিশ্বকে দিয়েছে অসংখ্য শিল্পী, খেলোয়াড়, বিজ্ঞানী। সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ রেড স্কয়ার, ক্রেমলিনসহ আরও অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থান এ শহরকে করেছে সমৃদ্ধ। ইতিহাসপ্রেমী-শিল্পমনা মানুষের জন্য এখানে রয়েছে জাদুঘর ও ট্রেটিয়াকভ গ্যালারি। বিশ্বের বড় দেশের রাজধানী শহরটি গড়ে উঠেছে মস্কোভা নদীর তীরে। মূলত নদীর নামানুসারেই শহরটির নামকরণ। স্থানীয়দের কাছে নদীটি মুস্তাজোকি (কালো নদী) হিসেবে পরিচিত। এটি পশ্চিম রাশিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। মস্কেভা মস্কো থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে হয়ে স্মোলেনস্ক ও মস্কো ওব্লাস্টের মধ্য দিয়ে প্রায় পুব দিক মধ্য মস্কো পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। মস্কোর প্রায় ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পুবের কোলোমনা শহর এবং ওকাতে প্রবাহিত হয়। মস্কোভা নদী নিজেই ভলগা নদীর উপনদী, যা শেষ পর্যন্ত ক্যাস্পিয়ান সাগরে প্রবাহিত হয়।

হাডসন নদের পাশে নিউইয়র্ক

নদের তীরে বসে থাকা আরেক শহর নিউইয়র্ক। কেউ একে বলে ‘বড় আপেল’, কেউ ‘না-ঘুমানো শহর’। এর বুক চিরে বয়ে গেছে বিখ্যাত হাডসন নদ। পূর্ব নিউইয়র্কের মধ্য দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হাডসন; যা নিউজার্সি ও নিউইয়র্কের অংশ বিভক্ত করেছে। পাশাপাশি এর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ৩০০-এর বেশি বিশাল অট্টালিকা। নিউইয়র্কের হাডসনের ওপর রয়েছে বিখ্যাত স্ট্যাচু অব লিবার্টি। ১৬০৯ সালে হেনরি হাডসন ৩১৫ মাইল দীর্ঘ হাডসন নদটি আবিষ্কার করেন। নিউইয়র্কের অ্যাডিরনডাক পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে হাডসন নিউইয়র্ক হারবারের আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে মিশেছে।

স্প্রি নদীর তীরে বার্লিন শহর

স্প্রি হলো বার্লিনের প্রধান নদী, যা জার্মানির রাজধানী শহর বার্লিনে অবস্থিত। বিখ্যাত নদীটি চেক প্রজাতন্ত্র ও জার্মানির সীমান্তবর্তী লুজাটিয়ান উচ্চভূমিতে উৎপন্ন হয়ে উত্তরের দিকে এগিয়ে স্পানডুতে গিয়ে হ্যাভেল নদীর সঙ্গে মিশেছে। বিখ্যাত এ নদীর দৈর্ঘ্য মাত্র ৪০০ কিলোমিটার; যা হ্যাভেল নদীর প্রধান একটি উপনদী। স্প্রি হ্যাভেলের চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘ; যা বার্লিন-স্প্যান্ডাউ হয়ে হ্যাভেলবার্গের এলবেতে প্রবাহিত হয়। জার্মান মুলুকে স্প্রি নদীর চেয়ে তিন গুণ বড় আরেকটি নদী রয়েছে। নাম রাইন। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে গড়ে ওঠা বার্লিনের সংস্কৃতি, শিল্প, খাদ্য এবং স্থাপত্য বহুমুখী। বার্লিন শহরে রয়েছে ইউরোপের ঐতিহ্য অপেরা হাউসও।

সর্বশেষ খবর