শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

আগুনে পোড়া শহরের কাহিনি

নানা উত্থান-পতনে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়াও মানবসৃষ্ট বিপর্যয় বারবার আঘাত হেনেছে সাজানো নগরীতে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অগ্নিকাণ্ড কিংবা দাবানলের কারণে জনসংখ্যার ধরন, অবকাঠামো এবং বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আজ রইল অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এমন কয়েকটি শহরের গল্প...

আবদুল কাদের

আগুনে পোড়া শহরের কাহিনি

লন্ডন : ১৬৬৬ সাল

গোটা ইংল্যান্ড দেখে আগুনের প্রভাব

২০২০ সালে করোনা মহামারি চলাকালে ক্যালিফোর্নিয়া দাবানলের আঘাত প্রথম নয়, ১৬ শতকে ব্ল্যাক প্লেগের সময় লন্ডনবাসী দেখেছিল ভয়াবহ এক অগ্নিকান্ড। ১৬৬৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর রবিবার। সেদিন লন্ডনের আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল আগুনের লেলিহান শিখা। ঘটনাস্থল ছিল একটি বেকারি, লন্ডন ব্রিজের কাছে পুডিং লেন তথা ফিস ইয়ার্ড। এই বেকারির মালিক ছিলেন থমাস ফ্যারিনার। একই সঙ্গে গ্রীষ্মকালীন সময়, কয়েক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টির অনুপস্থিতি, ফলত কাঠের বাড়িগুলো শুষ্ক থেকে যাওয়া এবং পূর্বমুখী বাতাস আগুনের ছড়িয়ে যাওয়াকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। ১৩ হাজারের বেশি বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। আর গৃহহীন হয়েছিল প্রায় ১ লাখের বেশি মানুষ। ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলা অগ্নির তান্ডবে মধ্যযুগীয় সেই শহরের বেশির ভাগ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছিল। যার মধ্যে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের মতো তৎকালীন অভিজাত ভবনও ছিল। অগ্নিকান্ডের ক্ষতিকর প্রভাব কেবল লন্ডনে নয়, পুরো ইংল্যান্ডবাসীকেই মেনে নিতে হয়েছিল।

রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছিল সারি সারি বস্তি। ধ্বংসযজ্ঞের কারণে শহরে খাবার পানির জোগান অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ে। অল্প কিছু বেকারি ব্যবসায়ী তাৎক্ষণিকভাবে খাবারের জোগান দিতে পেরেছিলেন। তাতে অবশ্য তারা অস্বাভাবিক লাভবানও হয়েছিলেন। লেখক স্যামুয়েল পেপিস অগ্নিকান্ড থেকে বাঁচতে পালিয়ে যাওয়ার সময় তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন- ‘প্রভু! মহাসড়কগুলোয় কীভাবে লোকেরা দৌড়াদৌড়ি করছে এবং মোটরসাইকেলের ভিড় এবং জিনিসপত্র বাঁচানোর জন্য গাড়ি নিয়ে আসাও ছিল বেশ কষ্টসাধ্য।’ লন্ডনের পুনর্নির্মাণে ৩০ বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল। কিন্তু স্যার ক্রিস্টোফার রেনের পরিকল্পিত শহরে আজও পাথুরে ভবন এবং বিস্তৃত রাস্তার দেখা মেলে।

আগুনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সরু গলি এবং কাঠের কাঠামোগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। তবে ‘গ্রেট ফার অব লন্ডন’ তৎকালীন ইংল্যান্ডে সম্পূর্ণ দুটি নতুন শিল্পের জন্ম দিয়েছে। এক. আধুনিক সম্পত্তি বীমা এবং দুই. ফায়ার ব্রিগেড।

সানফ্রান্সিসকো : ১৯০৬ সাল

ভূমিকম্পের কারণে ঘটে অগ্নিকান্ড

১৯০৬ সালের ১৮ এপ্রিল। ভোর সকাল পাঁচটা ১৩ মিনিটে রিখটার স্কেলে আনুমানিক ৮.০ মাত্রার কাছাকাছি একটি ভূমিকম্প ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে আঘাত হানে। মুহূর্তে বদলে যায় গোটা শহরের প্রেক্ষাপট। আনুমানিক ৩ হাজার মানুষ মারা যায়। কারণ এর কারণে সেদিন অসংখ্য ভবন ভেঙে পড়েছিল। ভূমিকম্পটি প্রায় ২৭৫ মাইল দূরে সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের স্লিপে সৃষ্ট হয়েছিল। যার কম্পন দক্ষিণ ওরেগন থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস পর্যন্ত অনুভূত হয়েছিল। ভূমিকম্পটি এক মিনিটেরও কম সময় স্থায়ী হলেও এর ধ্বংসযজ্ঞ ছিল ভয়াবহ। ভূমিকম্পের কারণে শহরের বেশ কটি এলাকায় আগুন জ্বলে ওঠে। সেই আগুন টানা তিন দিন ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় শহরজুড়ে। ২৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। ৪৯০টি অঞ্চল সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অগ্নিকান্ডের শেষ দিন ২০ এপ্রিল বিশাল অগ্নিকান্ডে আটকে থাকা কয়েক হাজার উদ্বাস্তুকে ভ্যান নেস এভিনিউয়ের পাদদেশ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী শহরজুড়ে ২০টিরও বেশি সামরিক তাঁবু ক্যাম্পে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বিশাল এই ক্ষয়ক্ষতির প্রাকৃতিক কারণ হিসেবে শক্তিশালী ভূমিকম্পকে দায়ী করা হয়। অন্যদিকে মানবসৃষ্ট কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ধসে যাওয়া বহু স্থাপনা অপসারণে দেরি, দক্ষ দমকলকর্মী দলের অভাব এবং ঘনবসতি। পর্যাপ্ত উপকরণের অভাবে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরাও এই ধ্বংসের মুখে পালিয়ে যেতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে ফায়ার চিফ ডেনিস সুল্লিভান পরিস্থিতি সামাল দেন। কিন্তু তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন। সান ফ্রান্সিসকোর জন্য এমন ধ্বংসের দিন ভালো ছিল না। পরে ঘুরে দাঁড়ায় সানফ্রান্সিসকো। কয়েক দশকে বদলে যায় শহরের চেহারা।

 

উইসকনসিন : ১৮৭১ সাল

দাবানলের আগুনে পোড়ে উইসকনসিন

ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর এই অগ্নিকান্ডটি ছিল আসলে দাবানল। এর আকার ও ভয়াবহতা সবার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৮৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের প্যাস্টিগো অঞ্চলে সূত্রপাত হওয়া এই দাবানলে পুড়ে গিয়েছিল ১২০ লাখ একর বন ও শহরাঞ্চল। একই দিনে হওয়ায় অনেকে শিকাগো আর পেস্টিগোর অগ্নিকান্ডকে গুলিয়ে ফেলেন। শিকাগো যখন পুড়ছিল তখন কে ভেবেছিল যে, মাত্র কয়েক শ কিলোমিটার দূরেই কিছুক্ষণের মধ্যে ঘটে যাবে ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর আরেকটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা? পেস্টিগোর সেই দাবানলে ঠিক কত মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল তা কোনো দিনই নিরূপণ সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হয়, হ্রদ, নির্জন দ্বীপ এবং লে ওয়েস্টের মাঝামাঝি অবস্থিত অঞ্চলটিতে আড়াই হাজার মানুষ মারা যায়। এখানে দুর্গম যোগাযোগ এলাকা আর অনুন্নত পল্লী অঞ্চলের জন্য সঠিক ধারণা পাওয়া যায়নি। পেস্টিগোর একটি ছোট্ট শহরেই ১ হাজার ৭০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। আগুনে অনেক লাশই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। বেঁচে থাকা অনেকের অঙ্গহানি হয়, আগুনে পোড়া শরীরের কষ্ট তাড়াতে পেসথিগোর নদীতে জীবন দেয়। কারণ নদীর পানি এতই শীতল ছিল যে, তাদের বেশির ভাগই হাইপোথার্মিয়ায় মারা যায়। কতটা কষ্টের হতে পারে এই পরিণতি তা কিছুটা হলেও পরিমেয়। এত বড় অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী করা হয় সেখানকার দাবানলকে। দাবানল থেকে একটি ঘূর্ণিঝড়েরও সূত্রপাত হয়। সেই অগ্নিঘূর্ণন রেলের বগিকেও অন্তত কয়েক শ ফুট দূরে নিয়ে ছিটকে ফেলে। এমনকি আস্ত আস্ত বাড়িও সেই ঘূর্ণনে শূন্যে উড়াল দিয়েছিল। উইসকনসিনের আশপাশের বাড়িঘর পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল এই দাবানলের আগুনে। তবে বর্তমানে শহরের পরিস্থিতি পাল্টেছে।

 

নিউইয়র্ক : ১৮৩৫ সাল

আগুনে পুড়ে গিয়েছিল শহরের কেন্দ্রস্থল

সালটা ছিল ১৮৩৫; তখন আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল কলেরা মহামারি। চারদিকে ছিল রোগে শোকে ক্লান্ত মানুষের মাতম। ১৮৩৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটি ছিল প্রচ- হিমশিতল। এত বেশি ঠান্ডা যে, শহরের পূর্বের নদীটি বরফে পরিণত হয়েছিল। এমনি পরিস্থিতিতে নিউইয়র্ক শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি গুদামে আকস্মিক আগুন ধরে যায়। তীব্র ঠান্ডা আর প্রবল বাতাস আগুনের লেলিহান শিখাকে উসকে দিয়েছিল। সেদিন খুব অল্প সময়েই শহরের ১৭টি ব্লকে এবং বরফে ঢেকে যাওয়া নদীর পাশের কিছু বসতবাড়িতেও আগুন ধরে যায়। তবুও লোকেরা সেই রাতে ব্রুকলিনের তীরে ভিড় করেছিল, নিউইয়র্ক শহরকে অসহায় দৃষ্টিতে জ্বলতে দেখেছিল। জর্জ উইলিয়াম শেলডন লিখেছেন, ‘সেদিন পুরো শহরকে আগুনের ভয়ংকর চাদর বলে মনে হয়েছিল।’ লোকেরা দেখছিল, আমেরিকার অর্থনীতি এবং ব্যবসা কেন্দ্র পুড়ে ছাই হয়েছিল এবং পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে; যা এখন ‘গ্রেট ফায়ার নিউইয়র্ক’ নামে পরিচিত। এই দাবানল অর্ধ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পত্তি ধ্বংস করেছিল। যদিও সে সময় আগুন নেভানোর জন্য শহরের পানি সরবরাহ ছিল অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। ড্যান লেভি বলেছেন, ‘সেদিন আগুনের সঙ্গে লড়াই করার জন্য দমকল কর্মীদের যা প্রয়োজন তা দেওয়া হয়েছিল। বাড়ির মালিক এবং ব্যবসায়ীরা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করেছেন। সময়টা এমন ছিল যে, শহরের লোকেরা ক্রমাগত মহামারির সঙ্গেও লড়াই করে বেঁচেছিলেন।’ এই অগ্নিকান্ড ১৮৩৭ সালে দিয়েছিল ক্রোটন অ্যাকুয়াডাক্টের বিল্ডিং; যা শহরে ১২ মিলিয়ন গ্যালন পানির সরবরাহ করতে পারে। এই অগ্নিকান্ড আমেরিকান পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং আমেরিকান প্রকৌশলীদের পুরো প্রজন্মের জন্য একটি প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

১৮৩৭ সালের মে মাসে ক্রোটন অ্যাকুয়াডাক্টের বিল্ডিং। “এটি প্রতিদিন ১২ মিলিয়ন গ্যালন নিয়ে এসেছিল, যা আগুনের সাথে লড়াই করার জন্য দমকল কর্মীদের যা প্রয়োজন তা দিয়েছে এবং বাড়ির মালিক এবং ব্যবসায?িকদের কাছে একটি বিশুদ্ধ উৎস সরবরাহ করেছে- এমন কিছু যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শহর ক্রমাগত মহামারীর সাথে লড়াই করছে,”

ধ্বংসের গতি কমানোর জন্য শহরের পানি সরবরাহ অত্যন্ত অপর্যাপ্ত ছিল। নিউ ইয়র্ক সিটির জনসংখ্যা গত দশকে ৬০ শতাংশ বেড়েছে এরি খাল বরাবর শক্তিশালী বাণিজ্যের জন্য ধন্যবাদ, এবং সঠিক স্যানিটেশন এবং বিশুদ্ধ পানির অ্যাক্সেসের অভাব ছিল।

ছাই থেকে উদ্ভাবন হল: ১৮৩৭ সালের মে মাসে ক্রোটন অ্যাকুয়াডাক্টের বিল্ডিং। “এটি প্রতিদিন ১২ মিলিয়ন গ্যালন নিয়ে এসেছিল, যা আগুনের সাথে লড়াই করার জন্য দমকল কর্মীদের যা প্রয়োজন তা দিয়েছে এবং বাড়ির মালিক এবং ব্যবসায?িকদের কাছে একটি বিশুদ্ধ উৎস সরবরাহ করেছে- এমন কিছু যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শহর ক্রমাগত মহামারীর সাথে লড়াই করছে,” ড্যান লেভি বলেছেন, আসন্ন ম্যানহাটন ফিনিক্সের লেখক। "এটি আমেরিকান জল ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং আমেরিকান প্রকৌশলীদের পুরো প্রজন্মের জন্য একটি প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, যারা দেশের জলজ রেলপথ এবং খাল তৈরি করতে যাবে।"

শিকাগো : ১৮৭১ সাল

ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে গৃহহীন হন ৯০ হাজার মানুষ

উনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব বিপর্যয়ের কথা শোনা যায়, ‘গ্রেট শিকাগো ফায়ার’ তার অন্যতম। ১৮৭১ সালের অক্টোবরের ৮ তারিখ রাতে আগুনের সূত্রপাত এবং তান্ডব চালায় ১০ তারিখ সকাল পর্যন্ত। সেই আগুন নেভানোর সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। বিধ্বংসী এই অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গোটা শিকাগো শহর। ধ্বংস হয়েছিল নগরীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। সেই অগ্নিকান্ডে নিহত হয়েছিল ৩০০ জন। আর গৃহহীন হয়েছিল ৯০ হাজারের বেশি মানুষ। প্রায় ১৭ হাজার বাড়িঘর পুড়ে কয়লায় পরিণত হয়েছিল। শিকাগো’স গ্রেট ফায়ার : দ্য ডেস্ট্রাকশন অ্যান্ড রেজারেকশন অব অ্যান আইকনিক আমেরিকান সিটি’র লেখক কার্ল এস স্মিথ বলেছেন, ‘যেহেতু তৎকালীন আমেরিকার টেলিগ্রাফিক নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে ছিল শিকাগো সিটি এবং ইউরোপের সঙ্গে যুক্তও ছিল; তাই এই অগ্নিকান্ড তাৎক্ষণিকভাবে আন্তর্জাতিক সংবাদ হিসেবে বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল।’ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ১০০ কোটি ডলার অনুদান দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল সাধারণ একটি প্রদীপ উল্টে যাওয়ার দুর্ঘটনায়। ঘটনা যাই হোক, আগুনে পোড়া ছাইয়ের ভিতর দিয়ে জাগরণ ঘটে নতুন শিকাগোর। সেই শিকাগো শহর ব্যবসার একটি শক্তিশালী অঞ্চলে পরিণত হয়। কয়েক দশকের ব্যবধানে আজকের বিশ্বে শিকাগো হয়েছে উন্নত মেট্রোপলিটন শহর।

 

বোস্টন : ১৮৭২ সাল

শহরের ৬৫ একর জমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল

আমেরিকার ইতিহাসে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘বোস্টন ফায়ার ডিজাস্টার’। এটি আমেরিকার ১০টি অগ্নিকান্ড থেকে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। ১৮৭২ সালের ৯ নভেম্বর বোস্টনের সামার স্ট্রিটে ৮০ নম্বর ব্লকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ১০ নভেম্বর পর্যন্ত এই আগুন তান্ডব চালায়; যার লেলিহান শিখা শহরের ডাউনটাউন এবং ফিন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্টের ৬৫ একর এলাকাজুড়ে ৭৭৬টি বিল্ডিংকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। অগ্নিনির্বাপক দলের পক্ষে এত বড় দুর্ঘটনা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বিরাট এলাকাজুড়ে চলমান অগ্নিকান্ড  থামাতে ছিল না পর্যাপ্ত পানি, পরিবহনের গাড়ি, লোকবল ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। জানা গেছে, গৃহযুদ্ধের পরের বছরগুলোতে বোস্টন শহরের বড় উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়ন যেমন- পানির সরবরাহ যথেষ্ট ছিল না। স্মরণকালের ভয়ংকরতম অগ্নিকান্ড দেখে মানুষ হয়ে পড়েছিল দিশাহারা।  সব মিলিয়ে ২০-২৫ জন মানুষ এই অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারিয়েছিল। যদিও নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী নানা মতপার্থক্য দেখা গিয়েছিল। এমন দুর্দিনে সবার পাওনা মেটানো ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর জন্য ছিল খুবই ব্যয়বহুল। সবার ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে অনেক কোম্পানি দেউলিয়া পর্যন্ত হয়ে যায়। এর পরই অঙ্গার হওয়ার হাহাকারকে বিদায় দিয়ে বোস্টন সিটি ফিরে আসে নতুন জৌলুসে।

 

রোম : ৬৪ খ্রিষ্টপূর্ব

দাউ দাউ করে আগুনে পুড়তে থাকে গোটা রোম শহর

খ্রিষ্টপূর্ব ৬৪ অব্দে জুলাই মাসে ভয়াবহ এক অগ্নিকান্ডের শিকার হয় রোম শহর। তৎকালীন রোমের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই কাঠের ঘর এবং খুপরিতে বসবাস করত। সে সময় রোমের অধিপতি ছিলেন সম্রাট নিরো। তবে বোদ্ধারা তাকে সম্রাটের পরিবর্তে একজন বিনোদনকারী  বলে মনে করতেন। তার শাসনামলে রোম পরিণত হয়েছিল নরককুন্ডে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, সেই অগ্নিকান্ডের ধ্বংসাবশেষ এতটাই বেশি ছিল যে, তার প্রমাণ হিসেবে কোনো ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট ছিল না। রোমান ঐতিহাসিক ট্যাসিটাস থেকে জানা যায়, মে মাসের সেই পূর্ণিমার রাতে আগুনের লেলিহান শিখা নরকে পরিণত করেছিল রোমের সরু রাস্তা এবং সংকীর্ণ গলিগুলোকে। মানুষের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়। সবাই পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিল। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ভিড় জমান রাজবাড়ির সামনে। রাজকর্মচারীরা তাদের তাড়িয়ে দেন। সম্রাটের কানে যায়নি মানুষের আর্তনাদ। কারণ নিরো ব্যস্ত তখন বাজনা নিয়ে। সম্রাট জানতেন রোম পুড়ছে। পাঁচ দিন আগুনে জ্বলেছিল এসকুইলিন পাহাড়ের পাদদেশ। মনে করা হয়, পাঁচ দিন আগুনে জ্বলে সব ধ্বসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সম্রাট ঘটনাস্থলে গিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ঐতিহাসিক সুটেনিয়াস বলেন, রাজা হিসেবে নিরো ছিলেন খুবই নিষ্ঠুর। নিজ আত্মীয়দের সঙ্গেও ছিলেন নির্মম।

 

টেক্সাস : ১৯৪৭ সাল

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সারে ধ্বংসস্তূপ টেক্সাস শহর

আমেরিকার টেক্সাস শহর ১৯৪৭ সালের ১৬ এপ্রিল বিশাল এক অগ্নিকান্ডের সাক্ষ্য হয়েছিল। বন্দরের একটি জাহাজ থেকে ২ হাজার ৩০০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট খালাস করার সময় একটি বিস্ফোরণ ঘটে। এতে মুহূর্তেই নিহত হয়েছিলেন ৫০০ মানুষ। আহত হয়েছিুেলন ৪ হাজার মানুষ। পুরো ডক এলাকা ধ্বংস হয়েছিল। আশপাশে থাকা অন্য কয়েকটি জাহাজে কয়েক দিন ধরে আগুন জ্বলতে থাকে। এমনকি আকাশে উড়ন্ত দুটি ছোট বিমানও ধ্বংস হয়। ওই বিস্ফোরণের ঝাপটায় সাগরে ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। তাতে অনেক বাড়ি ধ্বংস হয়ে ২ হাজার লোক গৃহহীন হন। কে ভেবেছিল, মালবাহী জাহাজ হবে বিরাট অগ্নিকান্ডের কারণ! প্রত্যক্ষদর্শী এলিসন বলেছিলেন, ‘যখন এটি বিস্ফোরিত হয়েছিল তাতে এমন কিছু ছিল যা আপনি আগে কখনো দেখেননি বা শোনেননি।

এলিসন আরও বলেন, তারা জাহাজটিকে নেভানোর চেষ্টা করছিলেন। অনেকটা টাইম বোমার ওপর দাঁড়িয়ে দমকল কর্মীদের কাজের কথা কল্পনা করুন। তারা সেদিন এভাবেই কাজ করেছিলেন। তাদের মধ্যে খুব কম কর্মীকে পরবর্তীতে পাওয়া গেছে।

বিস্ফোরণের পরেও বিভিন্ন রিফাইনারি সেকশনে একের পর এক আঘাত হানতে থাকে। এবার ভেবে দেখুন এটি কতটা ভয়াবহ ছিল। ২৫০ মাইল দূরের মানুষও প্রবাহিত দূষিত হাওয়ার জন্য অসুস্থ হতে থাকে। এলাকার ওপর প্লেন চলাচলের সময় দৃষ্টিসীমার বাইরে দিয়ে চলতে বাধ্য হয়। সব ক্ষতি কাটিয়ে টেক্সাস আজ আধুনিক স্থাপনার এক শহর।

 

টোকিও : ১৯২৩ সাল

ভূমিকম্প-অগ্নিকান্ডের তান্ডব দেখে সে সময়ের টোকিও

১৯২৩ সালে জাপানের টোকিওতে সংঘটিত অগ্নিকান্ডটি ছিল ১৭ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে হওয়া অগ্নিকান্ডের মতোই। এই অগ্নিকান্ডেরও কারণ ছিল বড় ধরনের ভূমিকম্প। বলা যায়, এই অগ্নিকান্ডেই ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। গণমাধ্যমগুলোর তথ্যমতে, সেই দুর্যোগে ১ লাখ ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত কিংবা নিখোঁজ হয়েছিলেন। ১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর। প্রথম আঘাতটি হানে ভূমিকম্প। সময় দুপুর ১১টা ৫৮ মিনিট। টোকিও থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণে সাগামি বে-এর মাটি থেকে ছয় মাইল গভীরে ভূমিকম্পের উৎপত্তি। ফিলিপাইন মহাসাগরীয় প্লেটের ৬০ মাইল অংশ ফেটে যায় এবং ইউরেশীয় মহাদেশীয় প্লেটে ধাক্কা দেয়। টেকটোনিক শক্তির একটি বিশাল বিস্ফোরণে নেমে আসে ধ্বংসযজ্ঞ। অস্ট্রেলিয়ার ৬১৫ ফুটের বিলাসবহুল স্টিমশিপে সেদিন ছিলেন মার্কিন নৌ অফিসার এলিস এম জাকারিয়াস। তার ভাষ্যমতে, ‘হাসি অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রচ- ঝাঁকুনিতে শিপ থেকে পিছলে পানিতে পড়ে গিয়েছিলাম।  পরে সুনামি ইয়োকোহামা এবং টোকিওতে আঘাত করেছিল।

ভূমিকম্পে যখন সব ভেঙে পড়ে তখন আগুনও বিক্ষিপ্তভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বাতাসের তোড় বাড়ে। শহরে অগ্নিঝড় এমনকি সুনামিও হয়। আগুন ও ভূমিকম্পে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। গৃহহীন হয় প্রায় ১৯ লাখ মানুষ। এসবই পুরনো    কথা। টোকিও এখন পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় শহর।

সর্বশেষ খবর