সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিলাসবহুল প্রমোদতরী

প্রমোদতরী শব্দটি উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশালাকৃতির ক্রুজ বা জাহাজ। সমুদ্রে ভেসে থাকা সত্ত্বেও যেখানে রয়েছে সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। কাটানো যায় অবকাশের সেরা সময়গুলো। দূর থেকে দেখলে মনে হয় এ যেন চলন্ত একটি শহর...

 

আইকন অব দ্য সিজ

পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও সাগরে ভাসল সবচেয়ে বড় প্রমোদতরী ‘আইকন অব দ্য সিজ’। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামি থেকে প্রথমবারের মতো সমুদ্রে যাত্রা শুরু করেছে ‘আইকন অব দ্য সিজ’। প্রথম যাত্রায় এতে যে-সংখ্যক যাত্রী উঠেছেন, তা ছোটখাটো একটি শহরের জনসংখ্যার সমান। ১২০০ ফুট দীর্ঘ জাহাজটির ২০টি ডেক, ৪০টির বেশি রেস্তোরাঁ, সাতটি সুইমিং পুল এবং ৭ হাজার ৬০০ যাত্রী বহনে সক্ষম। আর ওজন! আনুমানিক প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ৮০০ টন। আইকন অব দ্য সিস  প্রমোদতরীটির নির্মাণ প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার।

পরিবেশবাদীরা জাহাজটির সমালোচনা করে বলেছেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) চালিত জাহাজ বাতাসে ক্ষতিকারক মিথেন ছড়িয়ে দেবে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও এলএনজি সামুদ্রিক জ্বালানির চেয়ে বেশি পরিচ্ছন্নভাবে জ্বালানি পোড়ায়, তবে এটি মিথেন নির্গমনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, যা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন কিন ট্রান্সপোর্টেশনের (আইসিসিটি) সামুদ্রিক কর্মসূচির পরিচালক ব্রায়ান কমার বলেন, ‘এটি ভুল পথের পদক্ষেপ।’ তিনি আরও বলেন, ‘সামুদ্রিক জ্বালানি হিসেবে এলএনজি’র ব্যবহার সামুদ্রিক গ্যাস তেলের তুলনায় ১২০ শতাংশ বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করতে পারে। বায়ুমন্ডলে মিথেন ২০ বছরে কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ৮০ গুণ বেশি তাপ আটকে রাখে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমানোর জন্য এই নির্গমন হ্রাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এমন পরিবেশগত শঙ্কা থাকার পরও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল বিলাসবহুল এই প্রমোদতরীটি সাগরে ভাসিয়েছে। জাহাজে থাকা সব আয়োজন আগত যাত্রীদের সার্বক্ষণিক যাত্রীদের ব্যস্ত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। কী নেই এই বিলাসী প্রমোদতরীতে? যাত্রীরা যেন একঘেয়ে বোধ না করেন, তা নিশ্চিত করতে প্রমোদতরীতে বিভিন্ন ধরনের সুব্যবস্থা রেখেছে। ৭টি সুইমিংপুল, ৪০ হাজার গ্যালন পানির একটি ‘হ্রদ’, ৬টি ওয়াটার স্লাইড, একটি ক্যারোসেল এবং ৪০টির বেশি খাবারের জায়গা ও বার। এরপরও যদি যাত্রীর একঘেয়ে লাগে, তাহলে তাঁরা হারিয়ে যেতে পারেন সুরের জগতে। প্রমোদতরীটিতে আছেন ৫০ জন সংগীতশিল্পী ও কমেডিয়ান। আছে অর্কেস্ট্রার আয়োজনও।

যাত্রীদের কথা বলতে গেলে, ‘আইকন অব দ্য সিজ’ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ২ হাজার ৩৫০ জন ক্রু। আর সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৬০০ জন অতিথি বহনে সক্ষম, যা অ্যারিজোনার মোট জনসংখ্যার সমান। এর ক্যাটাগরি ৬-এ রয়েছে ১৭ হাজার বর্গ ফুট ওয়াটার পার্ক। বিশ্বের সমুদ্রে ভাসমান তরীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছড়িয়ে আছে ডেক ১৬ ও ১৭ তে। তন্মধ্যে ছয়টি স্লাইড রয়েছে, যা সমুদ্রের তরীগুলোর মধ্যে ভীতিকর বোল্ট (সমুদ্রে সবচেয়ে লম্বা ড্রপ স্লাইড ৪৬ ফুট বা ১৪ মিটার)। আছে সামুদ্রিক প্রথম পারিবারিক ভেলা স্লাইড (হারিকেন হান্টার এবং স্টর্ম সার্জ)। আরও আছে সমুদ্রের প্রথম ক্যান্টিলিভারড ইনফিনিটি পুল, সেইসঙ্গে সমুদ্রের বৃহত্তম সুইমিং পুল (৪০ গ্যালন লিটার রয়্যাল বে) এবং বৃহত্তম বরফের জমিন অ্যাবসোলিউট জিরো, যেখানে অতিথিরা স্কেটিং করতে এবং পারফরম্যান্স দেখতেও পারেন। জাহাজটির মালিক রয়্যাল ক্যারিবিয়ান বলছে, আধুনিক জাহাজের জন্য ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের চাহিদার চেয়ে আইকন অব দ্য সিস ২৪ শতাংশ বেশি শক্তি সাশ্রয়ী। কোম্পানিটি ২০৩৫ সালের মধ্যে নেট-জিরো জাহাজ চালু করার পরিকল্পনা করেছে।

 

হারমনি অব দ্য সিজ

‘হারমনি অব দ্য সিস’ অতীতের ওয়েসিস-শ্রেণির জাহাজগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে, যা একে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ক্রুজ জাহাজে রূপান্তর করেছে। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের ‘হারমনি অব দ্য সিজ’-এ ভূমধ্যসাগর কিংবা ক্যারিবিয়ানে ছুটিতে বিনোদনের জন্য জাহাজটিতে আয়োজনের কোনো কমতি রাখেনি কর্তৃপক্ষ। ২০১৩ সালে শুরু হয় এর নির্মাণকাজ। সময় লেগেছে তিন বছর। রয়েল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল নৌবহরের ২৫তম জাহাজ ‘হারমনি অব দ্য সিজ’ নির্মাণ খাতে ব্যয় হয়েছে ৭০০ মিলিয়ন পাউন্ড। এর প্রথম বিশেষত্ব হলো যাত্রী ধারণক্ষমতা। এটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জেট এয়ারবাস, যা ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে ছোটে। যা বর্তমানে যে কোনো জাহাজের চেয়ে অনেক বেশি। ১ হাজার ১৮৭ ফুট লম্বা জাহাজটি ৬ হাজার ৭৮০ জন যাত্রী বহন করতে পারে। এতে ২ হাজার ৭৫৯টি স্টেটরুম রয়েছে। সেই সঙ্গে ২৮টি বারান্দা। রয়েছে মোট ১৮টি ডেক। যার মধ্যে ১৬টি ডেকে রয়েছে ২ হাজার ৭৪৭টি কেবিন। দুই তলা বিশিষ্ট এই জাহাজের সিগনেচার রুমটিকে বলা হয় ‘রয়েল লফট স্যুট’। এর প্রথম তলাতে রয়েছে ১৬০০ বর্গফুটের লিভিং স্পেস। অন্যদিকে দ্বিতীয় তলাটি ৮৭৪ বর্গফুটের। দুটি মিলিয়ে ২৪৭৪ স্কয়ার ফুট। শহরের বড় যে কোনো বড় অ্যাপার্টমেন্টের চেয়েও অনেক বেশি বড়। যাত্রীদের জন্য রয়েছে ২০টি রেস্টুরেন্ট ও বার।

 

সিম্পনি অব দ্য সিজ

‘হারমনি অব দ্য সিজ’, এ যেন সমুদ্রের মধ্যে আরেক পৃথিবী। ২০১৮ সালে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল  এই বৃহত্তম জাহাজটি নিয়ে এসেছিল। এর আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ ছিল একই প্রতিষ্ঠানের ‘হারমনি অব দ্য সিজ’। মিয়ামির রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ক্রুজেস লিমিটেডের তৈরি এই বিশাল জাহাজটির মোট ওজন প্রায় ২২৮,০০০ টন। আর দৈর্ঘ্য ৩৬১.০১১ মিটার। ১৮ তলার এ জাহাজটিতে অতিথি থাকা যাবে ৫ হাজার ৫১৮ জন। তবে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৬৮০ জনের বেশি যাত্রী নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে ‘হারমনি অব দ্য সিজ’। এ ছাড়া রয়েছে ২ হাজার ২০০ ক্রু থাকার ব্যবস্থা। ১৮ তলার এই ক্রুজে কী নেই! লেজার ট্যাগ এরিয়া, রক ক্লাইম্বিং, আইস স্কেটিং রিং, রেসিং স্লাইডসহ বিশ্বের সব বিলাসিতার সম্ভার। অতিথিদের ব্যবহারের জন্য রয়েছে মোট ১৬ তলা, ২২টি রেস্টুরেন্ট, ১৮৮টি স্যুটস, চারটি সুইমিংপুল ও ২ হাজার ৭৫৯টি কেবিন। রয়েছে শিশুদের জন্য ওয়াটার পার্ক, বাস্কেটবল কোর্ট, আইস-স্কেটিং রিংক, ১ হাজার ৪০০ সিটের থিয়েটার, আউটডোর অ্যাকোয়াটিক থিয়েটার, ফিটনেস সেন্টারসহ অনেক কিছু। ক্রুজের অন্দরে রয়েছে বিশ্বের নামি সংস্থা বা ব্র্যান্ডের দোকান। মাঝে মাঝে রয়েছে শিশুদের জন্য ছোট ছোট প্লে-গ্রাউন্ড। ক্রুজের বায়োনিক বার। যেখানে কোনো কর্মী নয়, ড্রিংকস পরিবেশনে রয়েছে রোবট।

 

ওয়ান্ডার অব দ্য সিজ

‘ওয়ান্ডার অব দ্য সিজ’, পঞ্চম ওয়েসিস-শ্রেণির জাহাজ। প্রমোদতরীটি মূলত ২০২১ সালে হস্তান্তরের কথা ছিল। তবে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিলম্ব হয়। অবশেষে ২০২২ সালে জাহাজটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ২০২২ সালে ‘সিম্ফনি অব দ্য সিজ’-এর কাছ থেকে বিশ্বের বৃহত্তম ক্রুজ শিপ খেতাব পেয়েছিল। যাইহোক, সমুদ্রের বহুল প্রত্যাশিত নতুন-শ্রেণির আইকন আসার পর থেকে, জাহাজটি এখন সেই মুকুট হারিয়েছে। জাহাজটি ফ্রান্সের সেন্ট নাজায়ারের চ্যান্টিয়ের্স দে এল আটলান্টিক শিপইয়ার্ডে নির্মিত হয়েছিল। ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি জাহাজটি ক্রুজ লাইনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। প্রমোদতরীটি টাইটানিকের তুলনায় ৫ গুণ বড়। ২০২২ সালের ৪ মার্চ বিশাল প্রমোদতরীটি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ফোর্ট লডেরডেল বন্দর থেকে ক্যারিবিয়ানের উদ্দেশে প্রথমবারের যাত্রা করেছিল। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১১৮৮ ফিট ও প্রস্থ ২১০ ফিট। ২,৩৭,৮৫৭ টন ওজনের এই জাহাজটিতে ১৮টি ডেক রয়েছে। জাহাজটির যাত্রীধারণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৬৯৮৮ জন, ক্রুর ধারণক্ষমতা ২৩০০ জন। জাহাজটিতে একটি নতুন স্যুট ‘নেবারহুড’ যুক্ত করা হয়েছে। অষ্টম ডেকে রয়েছে ‘রয়্যাল স্যুট’, একটি গেস্ট স্যুট, সান ডেক, প্লাঞ্জ পুল, প্রাইভেট রেস্তোরাঁ, এমনকি আলাদা রেস্তোরাঁ ও বারও রয়েছে। এখানে সবচেয়ে বড় ‘আলটিমেট ফ্যামিলি স্যুট’ও রয়েছে।

 

ফ্রিডম অব দ্য সিজ

‘ফ্রিডম অব দ্য সিজ’, নামের মতো বিশাল জাহাজ। ৩ হাজার ৬৩৫ যাত্রী এবং ১ হাজার ৩০০ ক্রু পরিবহনে সক্ষম ক্রুজটি রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক পরিচালিত। জাহাজটি ফিনল্যান্ডের তুর্কু শিপইয়ার্ডে নির্মিত হয়েছিল। যারা ভয়েজার শ্রেণির জাহাজের পাশাপাশি ফ্রিডম শ্রেণির জাহাজেরও নির্মাতা। লিবার্টি অব দ্য সিস নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রমোদতরী। নাসাউ, বাহামাসের রেজিমন্টারভুক্ত হলেও ক্রুজটি পোর্ট অব ক্যানোভেরাল, ফ্লোরিডা এবং পোর্ট অব মিয়ামিতে ভ্রমণ করে। নেভিগেটর অব দ্য সির মতোই ফ্রিডম অব দ্য সিজ সেকেন্ড জেনারেশন ক্রুজ জাহাজ। ৯১ ফুট এলাকাজুড়ে ক্রুজটিতে পুল ডেক, ওয়াটার গার্ডেনের মতো রোমাঞ্চকর ইভেন্টের সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। ডাইনিং ভেন্যুর পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টার পিজা ভেন্যুর ব্যবস্থা আছে। ফ্লোরাইডার, বক্সিং রিং, জিম রিংয়ের পাশাপাশি বিশ্ববিখ্যাত বেন অ্যান্ড জেরিঞ্জ ব্র্যান্ডের আইসক্রিম পারলার আছে এখানে। তবে সাঁতার কাটার জন্য বিশেষ ধরনের সুইমিং পুল যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহী করে তোলে। জাহাজে ১৩তম ডেকটি রক ক্লাইমিং ওয়াল ফ্লোরাইডার এবং ক্ষুদ্র পরিসরে গলফ খেলার ব্যবস্থা রেখেছে। জাহাজের অভ্যন্তরে বড় আকৃতির ক্যাসিনো এবং ফ্ল্যাট প্যানেলে টেলিভিশন, জনি রকেট রেস্টুরেন্ট সত্যিই অভিভূত করবে।

সর্বশেষ খবর