রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

দেশে দেশে সোনার খনি

আবদুল কাদের

দেশে দেশে সোনার খনি

সোনা একটি মূল্যবান ধাতু। সবার কাছে গুরুত্ব পায় সোনা। তবে আদি যুগে এই ধাতু সম্পর্কে মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। জানা ছিল না সোনা উত্তোলনের কৌশল। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা খনির সন্ধানও ছিল না। এখন মানুষ সোনা নিয়ে রাজত্ব করা শিখেছে। কালে কালে গড়ে উঠেছে অসংখ্য সোনার খনি। এসব সোনার ভান্ডার নিয়েই আজকের আয়োজন...

 

ভূকম্পনে সৃষ্টি হয় স্বর্ণ!

স্বর্ণ নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এই ধাতব বস্তুর মূল্যও চোখে পড়ার মতো। তবে প্রশ্ন হলো- সোনা কীভাবে তৈরি হয়? কালে কালে এর উত্তরও বের করার চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের ভাষ্যমতে, ভূমিকম্পের ফলে নাকি তৈরি হয় সোনা। আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের ফলে নাকি সৃষ্ট ভূগর্ভস্থ তরল পদার্থগুলো খন্ডিত হয়ে ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়ে রূপান্তরিত হয় মূল্যবান সম্পদে। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের ভূ-পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষক ডিওন ওয়েদারলি জানান, ভূগর্ভস্থ তাপ ও চাপের ফলে তরল পদার্থগুলো পৃথক পৃথক কণায় রূপান্তরিত হয়। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন পদার্থ। ভূগর্ভের ১০ কিলোমিটার গভীরে পানির সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সিলিকা মিশে থাকে। যখন ভূকম্পন হয় তখন  প্রচ- তাপ ও চাপের ফলে ভেঙে যায় সেখানকার পানির কণাগুলো। এতে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থের সৃষ্টি হয়।

 

সোনার কদর রয়েছে সারা বিশ্বে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও এই ধাতব বস্তুটির প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। এই যেমন- করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দায় সোনার দামে ভীষণ অদলবদল দেখা গেছে। একইভাবে এর রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধেও সোনার দাম হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। কয়েক বছর আগের কথা, করোনা পরবর্তীতে আকস্মিক স্বর্ণের দাম আউন্সপ্রতি ২ হাজার ডলার ছাড়িয়েছিল। সেবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও স্বর্ণের মতো নিরাপদ সম্পদ কেনায় সতর্কতা জারি করেছিল।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, সোনার চাহিদার কারণে সোনার মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, আমরা প্রকৃতপক্ষে সেই অবস্থানে পৌঁছে গেছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খনির কাজ অনেকাংশে বন্ধ হয়ে গেছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৩৫১ টন সোনা উত্তোলন করা হয়েছিল; যা ২০১৮ সালের তুলনায় ১ শতাংশ কম। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যের বিবিসির বিশ্লেষণ অনুসারে জানা গেছে, যখন নতুন সোনার খনি আবিষ্কৃত হচ্ছে তখন বৈশ্বিক বৃহৎ সোনার মজুদ ক্রমবর্ধমানভাবে কমে আসছে। কেননা, সোনার বেশির ভাগ উৎপাদন এখনো কয়েক দশকের পুরনো খনিগুলো থেকে আসছে।

 

বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নেভাদার সোনার খনিতে বছরে প্রায় ১১৬ টন সোনা উত্তোলন করা হয়; যা বিশ্বের যে কোনো খনির হিসেবে নিশ্চিতভাবেই সর্বোচ্চ পরিমাণ। তার পরেই আছে উজবেকিস্তানের কিজিলকুম মরুভূমির মুরুনতাউ সোনার খনির অবস্থান। এর বার্ষিক সোনার উৎপাদনের পরিমাণও বৈশ্বিকভাকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। পরের অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রদেশের গ্রাসবার্গ সোনার খনি। যেখানে উত্তোলিত সোনার পরিমাণ গোটা বিশ্বে তৃতীয়। গ্রাসবার্গ শুধুমাত্র তৃতীয় বৃহত্তম সোনার খনিই নয়, বিশ্বের বৃহত্তম তামার খনিগুলির মধ্যে একটি। রাশিয়ার অলিম্পিয়াদা সোনার খনি ১৯৭৫ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। খনিটির সোনার উৎপাদনের নিরিখে বিশ্বে চতুর্থ। শুধু  গ্রাসবার্গ এবং অলিম্পিয়াদা ২০২১ সালে ১০ লাখ আউন্সের বেশি সোনা উৎপাদন করেছে। অলিম্পিয়াদা, রাশিয়ান সোনার খনির জায়ান্ট পলিউসের মালিকানাধীন প্রায় ২৬ মিলিয়ন আউন্স সোনার মজুদ রয়েছে।

সোনা উত্তোলন কতটা লাভজনক?

২০১৬ সাল থেকে সোনার দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চ, অর্থাৎ আউন্সপ্রতি দাম প্রায় ২ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২০ সালে সোনার খনির মালিকরা রেকর্ড মুনাফা অর্জন করেছে। ২০২০ সালে উৎপাদিত প্রতি আউন্স সোনার জন্য সোনার খনি মালিকদের পকেটে গড়ে ৮২৮ ডলার গেছে; যা ২০১১ সালের আগে সর্বোচ্চ মুনাফা। এদিকে বেশ কয়েকটি দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার বিগত কয়েক দশকের তুলনায় বেশ উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও এক অশনি সংকেত।

কেন স্বর্ণ এত মূল্যবান?

এ ধাতুটি বেশ দুর্লভ। এটি নমনীয় একটি ধাতু। এটি অন্যান্য ধাতুর চেয়ে কম সক্রিয় অর্থাৎ ওয়ান অব দ্য লিস্ট রিয়্যাক্টিভ কেমিক্যাল এলিমেন্টস। এটি প্রায় সব অ্যাসিডেই রেসিস্ট্যান্ট। আর এ কারণেই অন্যান্য সাধারণ ধাতুর মতো সোনা সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এটি বেশ ভালো ইলেকট্রিক কন্ডাক্টর। এককথায় স্বর্ণের সৌন্দর্য, চাকচিক্য ও ক্ষয়হীন বৈশিষ্ট্য একে অন্য সব ধাতুর থেকে অনন্য করেছে। আর এসব কারণেই এটি সবার কাছে খুব মূল্যবান। তাত্ত্বিকভাবে পারদ বা মারকিউরি থেকে নিউক্লিয়ার ফিউশন ও তেজস্ক্রিয় ক্ষয় বিক্রিয়ার সাহায্যে স্বর্ণ উৎপাদন সম্ভব। তবে পরীক্ষামূলকভাবে সোনা তৈরি বেশ ব্যয়বহুল। এতে এর দামও হবে অনেক বেশি।

পৃথিবীতে কত সোনা উত্তোলিত হয়েছে?

এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় ২ লাখ টন স্বর্ণ উত্তোলন করা হয়েছে, যা প্রায় ৪টি অলিম্পিক সাইজ সুইমিংপুলের সমান। ভাবছেন, এই বুঝি স্বর্ণের মজুত শেষ হয়ে গেল? আসলে তা না। ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষকদের মতে, পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরের ১ কিলোমিটারের মধ্যে আরও প্রায় ১ লাখ টন সোনা রয়েছে।

 

 

ভারতেও আছে সোনার খনি

ভারতের উত্তরপ্রদেশের নকশাল অধ্যুষিত সোনভদ্র জেলায় দুটি সোনার খনির সন্ধান মিলেছে। যেখানে প্রায় ৩ হাজার ৩৫০ টন সোনা মজুত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা দেশটির মোট সোনার মজুতের প্রায় পাঁচগুণ বেশি। বর্তমানে ভারতের সোনা মজুত আছে প্রায় ৬২৬ টন। ২০০৫ সাল থেকেই জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া টিম উত্তরপ্রদেশের এই এলাকায় সোনার সন্ধানে নানা কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে গেছে। দীর্ঘ অনুসন্ধান ও গভীর গবেষণার পর ২০১২ সালে সোনার উপস্থিতির প্রমাণ মেলে সোনভদ্র জেলায়। অঞ্চলটির খনি-সংক্রান্ত বিভাগের কর্মকর্তা কে কে রাই জানান, সোনভদ্র জেলার সোনাপাহাড়ি ও হারদি এলাকায় দুটি সোনার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সোনাপাহাড়ি খনিতে আছে ২৭০০ টন ও হারদি খনিতে আছে প্রায় ৬৫০ টন সোনা। সোনাপাহাড়ি খনিতে ইউরেনিয়ামের ভান্ডার থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই খোঁজও শুরু হতে পারে শিগগিরই। স্থানীয় প্রশাসনিক সূত্রের বরাতে জানা গেছে, সোনার খনির উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে খনি দুটি মাইনিংয়ের জন্য লিজে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জেলায় এই আবিষ্কারের পর সাত বিশেষজ্ঞ সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

যেসব দেশে সোনার মজুত বেশি

পৃথিবীতে সোনাকে অতি মূল্যবান ধাতু হিসেবে দেখা হয়। আদিকাল থেকে এর চাহিদা বেড়েছে, কখনোই কমেনি। তবে প্রশ্ন হলো- বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সোনার মজুত রয়েছে কোন কোন দেশে? দেখে নিন সেসব দেশের তালিকা। প্রত্যাশা মতোই এই তালিকায় সবচেয়ে ওপরে রয়েছে আমেরিকা। এ দেশের অর্থনীতিও রয়েছে সবচেয়ে বেশি। আমেরিকার হাতে থাকা সোনার মজুতের পরিমাণ রয়েছে ৮১৩৩ মেট্রিক টন। সোনা মজুতের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জার্মানি। আমেরিকা থেকে চার ভাগের এক ভাগ সোনা নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জার্মানি। যার মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩৩৫৫ মেট্রিক টন। ইউরোপ মহাদেশের অন্য একটি দেশও রয়েছে সোনার ভান্ডারের মজুতের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে। জার্মানি থেকে সামান্য পিছিয়ে ইতালির হাতে সোনা মজুত রয়েছে ২৪৫২ মেট্রিক টন। ইতালি ও ফ্রান্সকে সোনার ভান্ডার মজুতের হিসাবে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী বলা যেতে পারে। ইতালিতে সোনার মজুতের পরিমাণ যেখানে ২৪৫২ মেট্রিক টন, সেখানে ফ্রান্সের সোনা মজুদের পরিমাণ রয়েছে ২৪৩৭ মেট্রিক টন। সোনা মজুতের দিক থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নেই বিশ্বের আর এক পরাশক্তি রাশিয়াও। এ দেশে সোনার মজুতের পরিমাণ ২২৯৯ মেট্রিক টন। এশিয়ার অন্যতম শক্তিধর দেশ চীন রয়েছে এই তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে। চীনের কাছে মজুত সোনার পরিমাণ প্রায় ২০১১ মেট্রিক টন। সুইজারল্যান্ডে রয়েছে ১০৪০ মেট্রিক টন সোনা। চীনের থেকে সুইজারল্যান্ডে মজুত সোনার পরিমাণ অর্ধেকেরও কম। এশিয়ার আরও একটি দেশে মজুত সোনার পরিমাণ রয়েছে যথেষ্ট। জাপানে সঞ্চিত মোট সোনার পরিমাণ রয়েছে ৮৪৬ মেট্রিক টন। এই দেশ এই তালিকায় ভারত থেকে ঠিক এক স্থান ওপরে রয়েছে। ভারতের সোনা মজুতের পরিমাণ প্রায় ৭৮৭ মেট্রিক টন। আর তালিকার শেষে রয়েছে ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডস। নেদারল্যান্ডসে সোনার মজুতের পরিমাণ রয়েছে প্রায় ৬১২ মেট্রিক টন। সবচেয়ে বেশি সোনা মজুতের হিসাবে এগিয়ে রয়েছে নেদারল্যান্ডসও। তালিকায় এই দেশটি রয়েছে ১০ নম্বরে।

 

মুরুনতাউ উজবেকিস্তান

উজবেকিস্তানের মুরুনতাউ সোনার খনি- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খনিগুলোর অন্যতম। ধারণা করা হয়, ৩০ লাখ আউন্সের কম স্বর্ণ উৎপাদন, একে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনার খনি বানিয়েছে। উজবেক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন খনিটির দায়িত্বে রয়েছে নভোই কোম্পানি। ২০১৬ সালে এই সোনার খনি থেকে ৬০ টনের বেশি সোনা উৎপাদন হয়েছিল বলে একে বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি খনি বলে মনে করা হয়।  মুরুনতাউ স্বর্ণের খনিটি ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার চওড়া এবং প্রায় ৬০০ মিটার গভীর। মুরুনতাউ খনি উজবেকিস্তানের সামগ্রিক স্বর্ণ উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে।

 

নেভাদা গোল্ড মাইন আমেরিকা

২০১৯ সালের ১ জুলাই আমেরিকার নেভাদা অঙ্গরাজ্যে বিশ্বের দুটি বৃহত্তম স্বর্ণ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান ব্যারিক গোল্ড করপোরেশন এবং নিউমন্ট করপোরেশন যৌথভাবে নেভাদা গোল্ড মাইন পরিচালনা করে আসছে। প্রায় ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ মালিকানা নিয়ে ব্যারিক গোল্ড এবং   প্রায় ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ মালিকানা নিয়ে নিউমন্ট করপোরেশন উত্তর নেভাদাজুড়ে স্বর্ণ উত্তোলনে যৌথভাবে কাজ করে থাকে। ফলে নেভাদা গোল্ড মাইনস এখন বিশ্বের বৃহত্তম সোনার খনি। ২০১৬ সালে কানাডার ব্যারিক গোল্ড করপোরেশন নেভাদার এই খনি থেকে প্রায় ৩৪ টন স্বর্ণ উত্তোলন করেছিল। নেভাদা রাজ্যে প্রায় ১০টি ভূগর্ভস্থ সোনার খনি এবং ১২টি ভূপৃষ্ঠের সোনার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে ছয়টি খনি থেকে ব্যারিক গোল্ড করপোরেশন এবং নিউমন্ট করপোরেশন বার্ষিক ৩৩ লাখ আউন্স স্বর্ণ উত্তোলন করে থাকে। ব্যারিক গোল্ড করপোরেশন নেভাদা গোল্ড মাইন-এর মূল পরিচালক। ২০১৮ সালে নেভাদার এই গোল্ড মাইন থেকে প্রায় ১৭৩ দশমিক ৬ টন স্বর্ণ উৎপাদন করেছিল, যা মার্কিন স্বর্ণের ৭৮ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট স্বর্ণ উৎপাদনের ৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ করেছিল। যদিও ১৯ শতকের গোড়ায় নেভাদা রাজ্যের এই গোল্ড মাইন রৌপ্য উৎপাদনের জন্য বেশ পরিচিত ছিল। তবে স্বর্ণ উৎপাদনে এখানকার জেলাগুলো নাম ধীরে ধীরে বাড়ে।

 

গ্রাসবার্গ, ইন্দোনেশিয়া

গ্রাসবার্গ শুধু তৃতীয় বৃহত্তম সোনার খনিই নয়, বিশ্বের বৃহত্তম তামার খনিগুলোর অন্যতম। ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রদেশে এই খনিটির অবস্থান। এর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে  ফ্রিপোর্ট-ম্যাকমোরান কপার অ্যান্ড গোল্ড। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রাসবার্গ খনিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোনার খনি। ১৯৩৬ সালে সর্বপ্রথম এক ডাচ ভূতাত্ত্বিক গ্রাসবার্গের তামা-স্বর্ণের উৎস আবিষ্কার করেন।  এই ভূ-গবেষক সে সময় একে ‘ইর্টসবার্গ’ বা ‘অরিক পর্বত’ নামে অভিহিত করেছিলেন। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সোনা পাওয়া যায় গ্রাসবার্গে, ইন্দোনেশিয়ার এই খনিতে। এখানে সোনা, তামা এবং রূপা সংরক্ষিত আছে। ১৯৯০ সালে প্রথম গ্রাসবার্গ খনি থেকে সোনা উত্তোলন শুরু হয়েছিল। ইন্দো সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে এফসিএক্স কাজ করে; যা  ফ্রিপোর্টকে সোনা অনুসন্ধান এবং উৎপাদনে অনুমোদন দেয়। ২০১৮ সালের সর্বশেষে প্রাপ্ত হিসাব অনুসারে, ২৭ লাখ আউন্স সোনা উত্তোলন করা হয়েছিল এই খনি থেকে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ১০০ মিটার ওপরে পাপুয়া প্রদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় পুনকাক জায়ার কাছে এই সোনার খনিটি অবস্থিত। ৩০ হাজারের বেশি খনিশ্রমিক গ্রাসবার্গে জীবিকা নির্বাহ করে। ২০০১ সালে এই সোনার খনি থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ লাখ আউন্স সোনা উত্তোলিত করা হয়েছিল। সর্বশেষ ২০২১ সালে পাওয়া তথ্য অনুসারে, এই খনি থেকে ১৩ লাখ ৭০ হাজার আউন্স সোনা উত্তোলন করা হয়েছিল, যা ছিল ২০২০ সালের তুলনায় ৬২ শতাংশ বেশি। কারণ সেবার কোম্পানি সফলভাবে গ্রাসবার্গকে বিশ্বের বৃহত্তম আন্ডারগ্রাউন্ড ব্লক-কেভিং অপারেশন গোল্ড মাইনিংয়ে রূপান্তরিত করেছে।

 

অলিম্পিয়াদা, রাশিয়া

অলিম্পিয়াদা রাশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী সোনার খনির একটি। এটি বিশ্বের বৃহত্তম সোনার খনিগুলোর মধ্যেও অন্যতম। অলিম্পিয়াদা সোনার খনিটি পশ্চিম সার্বিয়ার ক্রাসনোয়ারস্ক ক্রাইতে অবস্থিত। বিশাল এই খনিটির তত্ত্বাবধানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি পিজেএসসি পলিউস। বিশাল এই ভোস্টোচনি এবং জাপাডনি পিট নিয়ে গঠিত। এখানে অনেক জটিল আকারে সোনা পাওয়া যায়। অলিম্পিয়াদা আকরিকের বেশির ভাগ কার্বোনেশিয়াস প্রকৃতির। ফলে এখান থেকে সোনা উত্তোলনও বেশ কঠিন। জানা গেছে, ১৯৭০-এর দশকে অলিম্পিয়াদায় অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল। একই দশকে এই সোনার খনিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে খনি থেকে প্রথম সোনা উত্তোলন শুরু হয়। বর্তমানে এই খনি থেকে উত্তোলিত সোনার পরিমাণ পলিউসের মোট সোনার উত্তোলনের অর্ধেকেরও বেশি। এখানকার তিনটি প্লান্টের মাধ্যমে- বিপুল আকরিক খনন করা হয়। বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ আকরিক এই খনি থেকে উত্তোলন করা হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত খনিটির আনুমানিক সম্পদের মজুতের পরিমাণ প্রায় ৪৮০ লাখ আউন্স। ধারণা করা হয়, প্রায় ২১০ লাখ আউন্স সোনার মজুত রয়েছে এখানে। জানা গেছে, অলিম্পিয়াদা খনি থেকে বছরে ১৩ লাখ আউন্স সোনা উত্তোলিত করা হয়। এই খনিতে ১০৪ মিলিয়ন আউন্সেরও বেশি সোনার মজুতের জন্য অলিম্পিয়াদা সোনার খনির পরিচালনা প্রতিষ্ঠান পলিউসকে সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় খনির উৎপাদকের মুকুট দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, রাশিয়ার এই সোনার খনির সম্ভাব্য খনিজ সম্পদের মজুতের পরিমাণ অনুমান করা হয় প্রায় ২৫২ মিলিয়ন টন।

 

পুয়েবলো ভিজো ডমিনিকান রিপাবলিক

পুয়েবলো ভিজো খনিতে কেবল সোনাই নয়, রুপাও রয়েছে। এটি ডমিনিকান রিপাবলিকের সানচেজ রামিরেজ প্রদেশের সোনা-রুপার খনি। যা রাজধানী সান্টো ডোমিঙ্গোর থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। ব্যারিক গোল্ড করপোরেশন এবং গোল্ডকর্প ইঙ্ক যৌথভাবে এটি পরিচালনা করে। এই খনি খননের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে, ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪১ সালের মধ্যে এটি বন্ধ হয়ে যাবে।  সম্প্রতি খনিটিতে সোনার উৎপাদন ছিল প্রায় ৩৬ টন। এটি ল্যাটিন আমেরিকার বৃহত্তম সোনার খনি এবং বিশ্বের ১৩তম বৃহত্তম সোনার খনি।

 

কিবালি, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গো

কিবালি সোনার খনি হলো কঙ্গোর উত্তর-পূর্ব গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ডোকো শহর-সংলগ্ন এবং উগান্ডার সীমান্তে আরুয়া থেকে ২১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ব্যারিক গোল্ড করপোরেশনের ৪৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক। আর অ্যাংলোগোল্ড আরও ৪৫ শতাংশের মালিক। বাকি শতাংশ হলো- সোসাইটি মিনিয়ের ডি কিলো-মোটোর। এটি একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনার খনির কোম্পানি। এটি আফ্রিকার বৃহত্তম সোনার খনির একটি। কিবালি নদীর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৫০ এর দশকে সোনার খনিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল।

 

ক্যাডিয়া অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম সোনার খনি হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমের ক্যাডিয়া বিশ্বের বৃহত্তম সোনার খনির তালিকায় সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। ক্যাডিয়া ইস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড প্যানেল এবং সেই সঙ্গে একটি রিজওয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড মাইন। এটি অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের অরেঞ্জ শহরের আঞ্চলিক শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে ক্যাডিয়া উপত্যকায় অবস্থিত বৃহৎ ভূগর্ভস্থ সোনা ও তামার খনি। ক্যাডিয়া খনিটি ১৯৯০-এর দশকে তৈরি করা হয়েছিল। এর বার্ষিক সোনা উৎপাদনের পরিমাণ গড়ে প্রায় ৮ লাখ ২৩ হাজার আউন্স।

 

লিহির পাপুয়া নিউগিনি

পাপুয়া নিউগিনির সোনার খনি লিহির গোল্ড মাইন। এর পরিচালনায় রয়েছে নিউক্রেস্ট মাইনিং লিমিটেড। সোনার খনিটি নিউ আয়ারল্যান্ড প্রদেশের নিওলাম দ্বীপে অবস্থিত। যা পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোর্সবি থেকে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, খনিটি একটি বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরির গর্তে অবস্থিত। ফলে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। ১৯৯৭ সালে সোনা উত্তোলন শুরু হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এখানে ৩০ বছরের সম্পদ মজুত রয়েছে। লিহির সোনার খনিতে প্রায় ২২০ লাখ আউন্স সোনার মজুত থাকতে পারে।

 

কানাডিয়ান ম্যালার্টিক কানাডা

কানাডিয়ান ম্যালার্টিক কানাডার সবচেয়ে বড় সোনার খনি। এটি বর্তমানে একটি ওপেন-পিট মাইন কিন্তু এর কার্যক্রম বৃহৎ ভূগর্ভস্থ প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যা ওডিসি প্রকল্প নামে পরিচিত। ২০২৮ সাল নাগাদ কানাডিয়ান ম্যালার্টিককে ভূগর্ভস্থ অপারেশনে রূপান্তরিত করে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৯ সাল পর্যন্ত এই খনিতে সম্পদের মজুত থাকতে পারে। কানাডিয়ান ম্যালার্টিক যৌথভাবে ইয়ামানা গোল্ড এবং অগ্নিকো ঈগলের মালিকানাধীন সোনার খনি। ১৯২৩ সালে খনিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। ২০১১ সালে বাণিজ্যিক খনির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।

 

বোডিংটন অস্ট্রেলিয়া

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বডিংটনের কাছে অবস্থিত বডিংটন সোনার খনি। এর পরিচালনায় রয়েছে নিউমন্ট করপোরেশন। ১৯৮৭ সালে ভূপৃষ্ঠের ৭০ মিটার গভীরে অবস্থিত খনিটি আবিষ্কৃত হয়। প্রাথমিকভাবে এখান থেকে ডিপ অক্সাইড আকরিক নিষ্কাশনের মাধ্যমে ওপেন-পিট অপারেশন শুরু হয়। ২০০১ সালে একে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে আনা হয়েছিল। ২০০৯ সালে বডিংটন সোনার খনি থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। ধারণা করা হচ্ছে, খনিতে ১২৩ লাখ আউন্স সোনার মজুত রয়েছে; যা আরও ২০ বছর অব্যাহত থাকবে।

সর্বশেষ খবর