সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
অগ্ন্যুৎপাত কতটা বিপজ্জনক

ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি

ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি

প্রকৃতিতে যত আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে অন্যতম আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। যা দীর্ঘকাল মানুষকে কেবল মুগ্ধই করেনি, অনেক সময় মানব সভ্যতার সমাধিও রচনা করেছে। পৃথিবীতে হাজার হাজার আগ্নেয়গিরি আছে। তবে কিছু আগ্নেয়গিরি অন্যদের চেয়ে আলাদা,  বিশেষত যেগুলো সক্রিয়; যার অগ্ন্যুৎপাত ছড়ায় লাভা...

 

কেন হয় অগ্ন্যুৎপাত?

পৃথিবীর ভিতরটা উত্তপ্ত। তরল উত্তপ্ত পদার্থ তাপ পরিচলন করে। তাপ পরিচালিত হয়ে পৃষ্ঠে বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসে। এর সঙ্গে আংশিক গলিত উত্তপ্ত শিলা বেরিয়ে এসে তাপ ছেড়ে ঠান্ডা হয়। ভিতর থেকে পরিচালিত হয়ে আসা বস্তু ম্যাগমা। বাইরে বেরিয়ে এলে বলে লাভা। বিস্ফোরণের সময় দেখা যায় আগ্নেয়গিরির ছাই, যা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। হাজার কিলোমিটার দূরে ছাই ছড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ‘স্বাভাবিক’। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর বেশির ভাগ আগ্নেয়গিরির সঙ্গে প্লেট টেকটোনিকের সম্পর্ক আছে। প্লেট টেকটোনিক মানে, আমাদের পৃথিবীর ভূ-ত্বক প্রধানত সাতটি বড় এবং কয়েকটি ছোট গতিশীল কঠিন প্লেট বা স্তর দিয়ে গঠিত, যেগুলো এর নিচের উত্তপ্ত পদার্থের ওপর ভাসমান। এ প্লেটের নড়াচড়া ও সংঘর্ষের কারণে ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত ও পর্বত সৃষ্টি হয়। এসব প্লেট জাপান, আইসল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্য অনেক জায়গায় আগ্নেয়গিরি তৈরি করেছে।

 

মাউনা লোয়া

হাওয়াই দ্বীপের একদম উত্তর-পূর্ব দিকে এই আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির তথ্য অনুযায়ী, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি। এটি পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, যেখান থেকে সারা বছরই লাভার উদ্গিরণ হয়। ‘মাউনা লোয়া’ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩,৬৭৭ ফুট ওপরে অবস্থিত। ধারণা করা হয়- প্রায় ৭ লাখ বছর আগে মাউনা লোয়া থেকে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। গবেষকদের মতে, আকার-আকৃতিতে মাউনা লোয়া ৩০ হাজার ফিট উচ্চতারও বেশি, যা মাউন্ট এভারেস্ট থেকেও লম্বা। ইউএসজিএস জানিয়েছে, ১৮৪৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় সক্রিয় এই আগ্নেয়গিরি থেকে ৩৩ বার লাভা উদ্গিরণের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে আগ্নেয়গিরিটি থেকে টানা ২২ দিন লাভা উদ্গিরণ হয়েছিল। ওই সময় মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে হিলো শহরে এর লাভা ছড়িয়ে পড়েছিল।

 

আইজাফজাল্লাজোকুল

আগ্নেয়গিরিটি দক্ষিণ আইসল্যান্ডের রেকজেইনস উপদ্বীপে অবস্থিত। আইজাফজাল্লাজোকুলের চারপাশ বরফের চাদরে আচ্ছাদিত। রাজধানী রিকজাভিক থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রিন্দেভিক শহর থেকে ৩ মাইল দক্ষিণে এর অবস্থান। প্রধানত মাছ ধরা ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অঞ্চলটি বিখ্যাত। এ আগ্নেয়গিরিটির একটি জটিল ইতিহাস রয়েছে। ভূতত্ত্ব বিভাগের দাবি, মূলত লাভা ও বরফের মিথস্ক্রিয়ার কারণে এ আগ্নেয়গিরি উদ্গিরণ হলে এখান থেকে নির্গত ছাইগুলো মেঘ তৈরি করতে পারে। ২০১০ সালে এটি থেকে বড় ধরনের অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। বায়ুমন্ডলে এত বেশি ছাই উঠেছিল যে পুরো ইউরোপে বিমান চলাচল বড় ধরনের বিঘিœত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এমনটা আর কখনো দেখা যায়নি। ভূতত্ত্ব বিভাগের দাবি, প্রায় ৮০০ বছর আগে এমন অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছিল।

 

ভিসুভিয়াস

ভিসুভিয়াস ইতালির নেপলস উপসাগরীয় অঞ্চলের একটি আগ্নেয়গিরি। নেপলস থেকে ৯ কিলোমিটার পুবে সমুদ্র উপকূলের খুব কাছে এর অবস্থান। তবে এর আশপাশে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের বসবাস। এটি ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত একমাত্র আগ্নেয়গিরি যাতে বিগত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। ১৯৪৪ সালে ভিসুভিয়াসে অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছিল। যদিও বর্তমানে এটিতে কোনো অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে না। তার মানে এই যে, এই আগ্নেয়গিরি থেকে কোনো অগ্ন্যুৎপাত হবে না। ভূতত্ত্ববিদদের দাবি, ২০ বছর পর পর জেগে ওঠে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি। যার অন্যতম উদাহরণ- ৭৯ খ্রিস্টাব্দের অগ্ন্যুৎপাতের ভয়ানক রূপ। সেবার এর অগ্ন্যুৎপাতের কারণে হারকিউলেনিয়াম এবং পম্পেই নগরীর পুরোটাই লাভার সমাধিতে পরিণত হয়। এরপর থেকেই ভিসুভিয়াসের মূল ভুখণ্ড থেকে অনেকটা নিরাপদ দূরত্বে মানুষ বসতি স্থাপন করে।

 

সাকুরাজিমা

সাকুরাজিমা জাপানের কিউশু দ্বীপের কাগোশিমার একটি আগ্নেয়গিরি। একসময় এটি কেবল একটি সাধারণ দ্বীপ ছিল। ১৯১৪ সালে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নিঃসৃত লাভা দ্বারা ভূতপূর্ব দ্বীপটি ওসুমি উপদ্বীপের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। বছরের পুরোটা সময় সাকুরাজিমায় হাজার হাজার ছোট ছোট বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আর গোটা এলাকাই আগ্নেয়গিরির ধোঁয়া এবং ছাইয়ে ঢেকে যায়। সাকুরাজিমা এখনো সক্রিয় একটি আগ্নেয়গিরি। ফলে মাঝে মাঝেই এর আশপাশের এলাকাগুলো নিয়মিতই ছাইয়ের আস্তরণে ঢেকে যায়। এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে ভয়ানক আগ্নেয়গিরি এই সাকুরাজিমা। যদিও আগ্নেয়গিরি থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে কাগোশিমার ৭ লাখ বাসিন্দার বসবাস। অতীতের অগ্ন্যুৎপাতসমূহের ফলে অঞ্চলটিতে সাদা বালির উচ্চভূমির দেখাও মেলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,৬৬৫ ফুট উঁচু কিতাদাকে হলো- এর সর্বোচ্চ চূড়া।

 

.

নিরাগঙ্গো

পূর্ব-মধ্য আফ্রিকার ভিরুঙ্গা পর্বতমালার একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ‘নিরাগঙ্গো’। এটি আফ্রিকার কঙ্গোতে অবস্থিত সবচেয়ে বড় সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। যা কঙ্গোর ভিরুঙ্গা জাতীয় উদ্যানের কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থিত। স্থানীয় গোমা শহর থেকে ১২ মাইল উত্তরে রুয়ান্ডার সীমান্তের কাছে অবস্থিত আগ্নেয়গিরি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১,৩৮৫ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত নিরাগঙ্গো। ১৮৮২ সাল থেকে কমপক্ষে ৩৪ বার বিস্ফোরণ ঘটেছে এই আগ্নেয়গিরিতে। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাভা হ্রদ। ১৯৭৭ সালে আগ্নেয়গিরির মুখের বিস্ফোরণের পর ঘণ্টায় ৬০ মাইল গতিতে এর লাভা ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশের গ্রামে। ফলে দেখা দেয় বিপর্যয়। ৭০ জনেরও বেশি গ্রামবাসী প্রাণ হারান। আগ্নেয়গিরির মুখে থাকা প্রাচীর গলতে ১ ঘণ্টারও কম সময় লেগেছিল এবং এই লাভা হ্রদের গভীরতা ছিল এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ পরিমাণ ১০ হাজার ৭০০ ফিট।

 

 পোপোকেটাপেটল

দক্ষিণ আমেরিকার মেক্সিকো শহরের কাছে অবস্থিত একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ‘পোপোকেটাপেটল’। বাংলায় যার শাব্দিক অর্থ- ধোঁয়ার পাহাড়। তবে স্থানীয়দের কাছে এটি এল পোপো নামে পরিচিত। এটি মেক্সিকোর দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে স্প্যানিশ পর্যটক দিয়েগো দে ওরডাজের নেতৃত্বে পোপোকেটাপেটলে একটি অভিযান হয়েছিল। জানা গেছে, পোপোকেটাপেটল আবিষ্কারের পর থেকে ১৫টি বড় ধরনের অগ্ন্যুপাতের ঘটনা ঘটে। এর বাইরেও আগ্নেয়গিরিটির অগ্ন্যুৎপাতের বেশ কয়েকটি প্রচলিত ইতিহাসও রয়েছে। অ্যাজটেক এবং অন্য আদিবাসীদের পৌরাণিক কাহিনি এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে মেক্সিকোর এই আগ্নেয়গিরিটি গভীরভাবে জড়িত। আগ্নেয়গিরিটি জনবহুল এলাকার কাছাকাছি থাকার কারণে মেক্সিকোর ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজাস্টার প্রিভেনশন সপ্তাহের সাত দিনই পর্যবেক্ষণ করে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর