সোমবার, ৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইউরোপের প্রাচীন শহর

ইউরোপের মাটিতে প্রথম সভ্যতা গড়ে তুলেছিল কারা? প্রশ্নটির বেশির ভাগ উত্তরই হয়তো হবে গ্রিকরা। কথাটা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না,  কারণ প্রাচীন গ্রিসকে বলা হয় এজিয়ান সভ্যতার অংশ। ইউরোপের প্রাচীনতম জনবসতিপূর্ণ স্থানগুলো কেবল গ্রিসে আবদ্ধ নয়। ছড়িয়ে আছে গোটা ইউরোপেই...

 

প্রাচীনতম নগরী ‘রোম’

বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত শহরের একটি হলো রোম। যা পৃথিবীর সমৃদ্ধতম প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম যা খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর প্রথমভাগে ইতালীয় উপদ্বীপে সূচিত হয়। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এ নগরী টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। প্রবাদ আছে ‘রোম কিন্তু একদিনে গড়ে ওঠেনি।’ একাগ্রতা এবং অধ্যবসায়ই যে সাফল্যের চাবি তা বোঝানোর জন্য এ প্রবাদের জন্ম। রোমান পুরাণে উল্লেখ অনুযায়ী ৭৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে ‘সাত পাহাড়ের নগরী’ রোমের প্রতিষ্ঠা হয়। এ অঞ্চলে অনেক আগে থেকে মানববসতি ছিল, যার ফলে এটি ইউরোপের প্রাচীনতম নিরবচ্ছিন মানববসতিযুক্ত শহরগুলোর অন্যতম। শহরটি ধারাবাহিকভাবে রোমান রাজ্য, রোমান প্রজাতন্ত্র ও রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। ‘বিশ্বের রাজধানী’ খ্যাত শহরটির পতন হয়েছিল রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে। বহিঃশক্তির আক্রমণ, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নৈতিক অবক্ষয়, আবহাওয়ার বিপর্যয়, অত্যধিক বিস্তৃত সাম্রাজ্য, ধর্মীয় সংস্কার, প্রশাসনিক দুর্বলতা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এ সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল বলে জানা যায়। অলিম্পিকের জন্য বিখ্যাত এ নগরীতে ভাস্কর্যকে একটি বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছিল। আভিজাত্যের বাড়িতে ভবন, কলাম, ঝরনা এবং উঠানের দেয়ালে প্রচুর পরিমাণে সজ্জিত ছিল এসব ভাস্কর্য। চিত্রকর্মের মতো, রোমানরাও ভাস্কর্যে গ্রিকদের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না। রোমান ভাস্কররা পাথর, মূল্যবান ধাতু, কাচ, পোড়ামাটি, ব্রোঞ্জ এবং মার্বেল দিয়ে তৈরি করতেন সেসব ভাস্কর্য। বর্তমানে রোমের গ্লোবাল শহরের স্বীকৃতি আছে। ২০১১ সালে, রোম পৃথিবীর ১৮তম সবচেয়ে বেশি ভ্রমণকারী শহর, ইউরোপীয় ইউনিয়নে তৃতীয় এবং ইতালির সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ইউনেস্কো এ শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকাভুক্ত করেছে।

 

ইতিহাস উৎসাহীদের স্বপ্নময় গন্তব্য গ্রিসের ‘আর্গোস’

নাফপ্লিও থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্ব পেলোপোনিসে অবস্থিত আর্গোস। এটি ছিল মাইসেনিয়ান যুগের প্রধান দুর্গ। আর্গোসের একটি গ্রামে ৭ হাজার বছর আগে পেলোপোনিজরা বসবাস করত। বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে- ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ নগরীতে পেলোপোনিজদের বসবাসের প্রমাণ মেলে। মাইসেনিয়ান যুগে (১১০০-১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে- এখানে অত্যাচারী রাজা ফেইডনের রাজত্ব ছিল। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে, শহরটির নামকরণ করা হয়েছিল জিউস এবং নিওবের পুত্রের নামে। হোমারের ইলিয়াড এ নগরীকে একটি বিখ্যাত ঘোড়া-প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হেরা, নারী ও বিবাহের দেবী, বিশেষভাবে সম্মানিত ছিলেন। মাইসেনিয়ান সমাধি, অ্যাফ্রোডাইটের অভয়ারণ্য এবং ২০ হাজার লোকের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটি থিয়েটার আজও দেখা যায়।

 

ম্যারাথনের যুদ্ধে জিতে ‘অ্যাথেন্স’ স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে

গ্রিসের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর ‘অ্যাথেন্স’। এ নগরীতে রোমান, অটোমান এবং বাইজেনটাইন সভ্যতাগুলো সাড়ে সাত হাজার বছরের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে রেখেছে। এর ইতিহাস ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের, যখন শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নগরীটি গণতন্ত্র, দর্শন ও প্রাচীন সভ্যতার প্রতীক। জানা গেছে, অ্যাক্রোপলিসরা কমপক্ষে ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ শহরে বাস করত। গ্রিক কিংবদন্তি বলেন, এথেনা পোসেইডনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জলপাইয়ের বীজ রোপণের পরে অ্যাথেন্স শহরের নাম জিতেছিলেন। গণতন্ত্রের জন্মস্থান খ্যাত শহরটি হানাদাররা জয় করে ঠিকই, কিন্তু শহরটিকে লুট করতে দেয়নি এবং নাগরিকেরা দাসত্ব মেনে নেয়নি। ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যারাথনের যুদ্ধে এথেনীয়রা পার্সিয়ানদের পরাজিত করে। পরে পেরিকিসের শাসনের অধীনে শহরটি তার স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। এ শহরেরই জন্ম সক্রেটিস, হিপোক্রেটিস এবং সফোকিসের।

 

রাজাদের সমাধি ও বিস্ময়ের নগরী ‘নিকোসিয়া’

রাজাদের চিত্তাকর্ষক সমাধি এবং ঐতিহাসিক বিস্ময়ে ভরপুর সাইপ্রাস। নিকোসিয়া দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। এটি পেডিয়োস নদীর তীরে মেসোরিয়া সমভূমির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।  ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ এটি। বিখ্যাত শহরটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রায় ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নিকোসিয়া, তখন এটি লেড্রা নামে বেশি পরিচিত ছিল। এখানে প্রথম সভ্য মানুষ আসে আনাতোলিয়া থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২ হাজার ৪০০ বছর আগে। আর গ্রিকরা আসে খ্রিস্টপূর্ব ১ হাজার ৬০০ বছর আগে। সাইপ্রাস ইতিহাসের বিভিন্ন সময় গ্রিক, রোমান, পারসীয়, বাইজেনটাইন, আরব এবং মিসরীয় শাসকদের অধীনে শাসিত হয়। অটোমান যুগের নানা স্থাপত্য শিল্প এবং ব্যস্ততম লেড্রা স্ট্রিটের মতো স্থান ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে। ইউরোপের শেষ বিভক্ত রাজধানী হিসেবে নিকোসিয়া আজও অনন্য।

 

প্রাচীন ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী ‘প্লোভদিভ’

ইউরোপের প্রাচীনতম জনবসতিপূর্ণ শহর প্লোভদিভ। প্রায় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ নগরীটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যার রয়েছে ৬০০০ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। বর্তমানে এটি বুলগেরিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী। এবং দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ঐতিহাসিক থ্রেসে অঞ্চলের মেরিতসা নদীর তীরে অবস্থিত প্লোভদিভ। এ নগরীতে ক্রমাগত নিওলিথিক, থ্রেসিয়ান, ম্যাসোডিনিয়ান, গ্রিক, রোমান, বাইজেনটাইন ও অটোমানদের আধিপত্য ছিল। এদের ধ্বংসাবশেষ আজও মানুষকে বিস্মিত করে তোলে। এটি ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, পরিবহন, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাকেন্দ্র। প্লোভাদিভ মেসিডোনের দ্বিতীয় ফিলিপের নাম অনুসারে ফিলিপপোলিস নামে পরিচিত ছিল। ফিলিপোপলিস থিয়েটার, ৩০ হাজার দর্শকের বসার স্টেডিয়াম, প্রাচীন দুর্গ এবং ঐতিহ্যবাহী বুলগেরিয়ান স্থাপত্য-সহ পুরানো শহরতলিটি আজও ইতিহাসকে আগলে রেখেছে।

 

ফিনিশিয়ানরা প্রতিষ্ঠা করেছিল স্পেনীয় ‘কাডিজ’

আইবেরিয়ান উপদ্বীপের প্রাচীনতম অবিচ্ছিন্ন জনবসতিপূর্ণ শহর ‘কাডিজ’। জানা গেছে, ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় শহরটি। লেবাননের ফিনিশিয়ানরা কাডিজ প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের কাছে এটি ‘গাদির’ নামে পরিচিত ছিল। এক সময় প্রাচীন নগরীটি অ্যাম্বার বাণিজ্যের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার হতো; পরবর্তীতে রোমানরা এটিকে নৌঘাঁটি হিসেবে গ্রহণ করে। শহরটি খ্যাতি পাওয়ার আগে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকায় তার দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সমুদ্রযাত্রায় এ ঘাঁটি ব্যবহার করেছিলেন।  শহরটির চমৎকার সৈকত, প্রাণবন্ত সংস্কৃতি এবং কাডিজ ক্যাথেড্রাল পর্যটকদের মোহিত করে। টেলিগ্রাফ ট্রাভেলের স্পেনীয় বিশেষজ্ঞ অ্যানি বেনেট বর্ণনা করেন, ‘গোলাপি, সবুজ এবং নীল রঙের প্যাস্টেল টোনে আঁকা পাথরের প্রাসাদ, সোজা রাস্তার শেষে ঝিকিমিকি করে সূর্যাস্তের সোনালি আলোর সমুদ্র।

 

পর্তুগালের প্রাণবন্ত রাজধানী প্রাচীনতম ‘লিসবন’

‘লিসবন’ পর্তুগালের রাজধানী ও বৃহত্তর শহর। এটি আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে তাগুস নদীর তীরে অবস্থিত। আধুনিক লিসবন ও আশপাশে বসতিগুলো ২,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, ক্যাসেলো দে সাও এবং ক্যাথেড্রালের কাছে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন প্রমাণ করে ১,২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এখানে ফিনিশিয়ানদের বসবাস ছিল। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত ক্যাসটেলো হিল ছিল জনবহুল নগরী। পরে শহরটি মুররা জয় করে নেয়। তৎকালীন সময়ে এ মুরেরা মরক্কো থেকে ইউরোপে এসে একটি ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৫৫ সালের নভেম্বরে এক বড় ভূমিকম্প গোটা শহরের ভবিষ্যৎ বদলে দেয়। এতে শহরটির দুই-তৃতীয়াংশ ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। ১ লাখ ৮০ হাজার লোকের মধ্যে ৬০ হাজার মারা যায়। বর্তমানে লিসবন পর্তুগালের প্রাণবন্ত রাজধানী।

সর্বশেষ খবর