শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কেন জরুরি

লাকী আক্তার

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কেন জরুরি

নারীকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন করে, সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে শুধু পণ্যের মোড়কে নারীর জাঁকজমক ছবি দেখিয়ে যে নারী মুক্তি হয় না, তা এখন কেউই অস্বীকার করবে না।  রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে নারীকে পিছিয়ে থাকা মানেই দাসত্বকে প্রলম্বিত করা। নারীরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত থাকার পরও কিন্তু নারী নির্যাতন থেমে নেই

 

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরে সুই তৈরির কারখানার নারী শ্রমিকরা বিপজ্জনক এবং অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্পমজুরি ও দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রমের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চের নিউইয়র্ক শহরের নারী শ্রমিকদের এই প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ১৮৫৭ সালের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৮৬০ সালে সুই তৈরি কারখানার নারী শ্রমিকরা ইউনিয়ন গঠনের আইনগত অধিকার আদায় করে নিতে সক্ষম হন। ন্যায্য মজুরি আর আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি পূরণে ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আবারও নিউইয়র্ক শহরের রাজপথে সমবেত হন পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের হাজার হাজার নারী শ্রমিক। ঠিক পরের বছরই (১৯০৯) প্রায় একই দাবিতে আমেরিকার ৩০ হাজার নারী শ্রমিক ১৩ সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট পালন করেন। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সমাজতান্ত্রিক নারীদের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের দ্বিতীয় সভায় জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিন শ্রমজীবী নারীদের বছরে একটি নির্দিষ্ট দিনে একত্র হওয়ার একটা খসড়া প্রস্তাব করেন, যাতে ওই নির্দিষ্ট দিনে নারী শ্রমিকরা একত্র হয়ে মতবিনিময় করতে পারেন। ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ৮ মার্চকে নারীদের সম্মিলিত হওয়ার দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যদিও ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায় তারও ১১৭ বছর পর ১৯৭৪ সালে। আজ সারা বিশ্ব ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চের নিউইয়র্ক শহরের নারী শ্রমিকদের এই প্রতিবাদ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো নারী দিবসের সঙ্গে শ্রমজীবী নারীদের ঐতিহাসিক যোগসূত্র এবং তার ইতিহাস অনেকটাই আজ করপোরেট বিজ্ঞাপনের চাদরে ঢেকে গেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীরা আসীন রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্ন এলেই অনেকেই তোতা পাখির মতো বলতে থাকেন, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারি দল এবং বর্তমান অনুগত বিরোধী দল কিংবা সাবেক বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। আর এতেই অনেকে নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান ঠিক কতটুকু। উল্লেখ্য, রাজনীতিতে নারীদের সামনে আনতে ২০০৮ সালে আইনের পরিবর্তন করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই সময় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ২০২০ সালের মধ্যে সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলেই এই শর্ত পূরণ হয়নি। এমনকি আমাদের পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে এই হার ২৭.৯১ শতাংশ হলেও সারা দেশের জেলা কমিটিগুলো হিসাব করলে দেখা যাবে সেখানে এই হার আশঙ্কাজনকভাবে নিম্ন। পারিবারিক কিংবা সামাজিক বাধা ঠেলে নারী রাজনীতিতে অংশগ্রহণে পিছিয়ে। ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক আন্দোলনেও নারীর অংশগ্রহণ কম। বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে যে নারীরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, তারাও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কার্যকর অবস্থানে থাকার সুযোগ হয় না সব সময় এবং রাষ্ট্রক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ স্তরে নারীদের উপস্থিতিই নারীর ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করে না। বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া এ অবস্থা থেকে মুক্তি নেই।

বাংলাদেশের ভূমি, ঋণ ব্যবস্থা, কৃষি উপকরণ কিংবা বাজার কোথাও নারীদের জন্য সমতাভিত্তিক প্রবেশাধিকার নেই। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নারী কৃষিতে নিয়োজিত থাকলেও এ খাতে বেশির ভাগ নারীর অবদান অস্বীকৃত ও অদৃশ্য থেকে যায় রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি পরিবারের কাছে। নারীর অবদানকে কেবল ‘সংসারের কাজ’ আখ্যায়িত করে তার অবদানকে সংকুচিত করার মানসিকতা এখানে স্বাভাবিকীকরণ হয়ে গেছে। জিডিপিতে গৃহস্থালি কাজ কিংবা কৃষিতে নারীর শ্রমের কোনো মূল্যায়ন প্রতিফলিত হয় না। তাছাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের বিভিন্ন আইন, নীতি ও সামাজিক চর্চা সম্পত্তিতে নারীর মালিকানার বিষয়টি সমর্থন করে না। এ সংকটের সমাধানের জন্য নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং নীতি-নির্ধারণে নারীর সমতাভিত্তিক উপস্থিতি খুবই জরুরি।

নারীকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন করে, সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে শুধু পণ্যের মোড়কে নারীর জাঁকজমক ছবি দেখিয়ে যে নারী মুক্তি হয় না, তা এখন কেউই অস্বীকার করবে না। রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে নারীকে পিছিয়ে থাকা মানেই দাসত্বকে প্রলম্বিত করা। নারীরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত থাকার পরও কিন্তু নারী নির্যাতন থেমে নেই। পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং দেশের ভিতর ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে-সর্বত্রই নারী পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসন মুক্ত নয়।

নারী মুক্তির লড়াই অগ্রসর করতে গেলে বাধা আসবে। রাজনীতির মাঠে প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা উত্থাপিত হতে পারে হেফাজতের ১৩ দফা, নারীনীতি বাতিল কিংবা রাজনৈতিক দলের কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণের ৩৩% প্রতিনিধিত্ব বাতিলের দাবিও। রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত ওয়াজ মাহফিলে নারীর প্রতি কুৎসা কিংবা অবমাননাকর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সামাজিক মনস্তত্ব কিংবা হেজিমনিতে নারীরা অধস্তন হিসেবে উপস্থাপিত হতে থাকবে। ইন্টারনেটের বদৌলতে অনলাইনে হোক কিংবা সমাজের আনাচে-কানাচে নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য তো আমাদের সমাজে চিরচেনা। কিন্তু এই চিরচেনা অবস্থান বদলাতে হলে রাষ্ট্রের মগজে মননে নারী মুক্তির প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নারী আসীন থাকলেও রাষ্ট্রের চরিত্র পুরুষতন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে যায় না। রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা কাঠামো বদলাতে হবে। সে জন্য নারীকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়িত হওয়া এবং নারীর প্রতি বৈষম্যহীন কাঠামো তৈরির মধ্য দিয়েই এ অবস্থার বদল ঘটতে পারে। নারীর জন্য পুরো পৃথিবীটাই এক যুদ্ধক্ষেত্র। এ যুদ্ধক্ষেত্রে নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব মানুষকে নারী দিবসের সংগ্রামী শুভেচ্ছা।

 

 লেখক : সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটি

সর্বশেষ খবর