মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

অনিল আম্বানি ছিলেন রাজা হলেন ভিখারি

আবদুল কাদের

অনিল আম্বানি ছিলেন রাজা হলেন ভিখারি

এক সময় বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনবানের কাতারে ছিলেন অনিল আম্বানি। বাবার মৃত্যুর পর তার বিশাল সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে বড় ভাই মুকেশ আম্বানির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে সম্পদের ভাগাভাগি হয়ে যায়। বেছে বেছে বড় ব্যবসাগুলোর মালিকানা নিয়েছিলেন তিনি। একপর্যায়ে যোগ দনে ভারতীয় রাজনীতিতে। স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার। কিন্তু ব্যবসায় উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত এবং ঋণ পরিশোধে গাফিলতি পরবর্তীকালে কাল হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় এই ধনকুবেরের। ঋণ শোধে ব্যর্থতায় দাঁড়াতে হয়- আদালতের কাঠগড়ায়। সেখানে বলেন- ‘আমি দেউলিয়া, স্ত্রীর গয়না বেচে সংসার চালাচ্ছি’। এক সময়ের ধনবান অনিল ছিলেন রাজা, হলেন ভিখারি...

 

যেভাবে ধনকুবের অনিল আম্বানির ব্যবসায় ধস নেমেছিল

২০০০ সালের কথা, ভারতের ব্যবসার জগতে বেশ সাফল্য আর সম্ভাবনাময় পথ দেখিয়েছিলেন অনিল আম্বানি। ভারতের অন্যতম ধনকুবের ধীরুভাই আম্বানির ছোট ছেলে তিনি। তার বড় ভাই দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানি। ২০০২ সালে তাদের বাবা ধীরুভাই আম্বানির মৃত্যুর পর রিলায়েন্স কোম্পানিগুলোর যৌথ নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সে সময় ধীরুভাই আম্বানির ছিল ২৫ হাজার কোটি রুপিরও বেশি সম্পদ। তবে ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভাইদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসায়, মা কোকিলাবেন আম্বানি দুই ভাইয়ের মাঝে সম্পদ ভাগ করে দেন। আর ব্যবসা ভাগাভাগির সময়ই এগিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন অনিল আম্বানি। মুকেশের সঙ্গে তার মতবিরোধের কারণ- ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে তিনি কিছুটা জেদি হওয়াটাকে ভালো মনে করতেন। অন্যদিকে বড় ভাই মুকেশের দারুণ নেতৃততুগুণ ব্যবসায়িক উন্নতি লাভ করতে থাকে। অনিল ব্যবসার নতুন সেক্টরগুলোকে নিজের হাতে রাখতে চাইলেন। কিনে নিলেন অ্যাডল্যাবস। এরপর ভারত ও ভারতের বাইরে প্রায় ৭০০টি আইম্যাক্স বিগ সিনেমা স্ক্রিন তৈরি করে। ভেবেছিলেন এ ব্যবসায় আধিপত্য তৈরি করবেন। যা ভুল প্রমাণিত হয়। কারণ আইম্যাক্স বিগ সিনেমা স্ক্রিন ব্যয়বহুল হওয়ায় দর্শক টানতে পারেনি। শোবিজ অঙ্গনের তারকা ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করেন অনিল। সেটাই কাজে লাগিয়ে মুকেশের সঙ্গে সম্পত্তি বিরোধের জেরে মামলা ঠুকে দেন। কিন্তু আদালতে জয় পান মুকেশ। অনিলের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান ছিল রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স। সেখানে তারা ব্যবহার করতেন সিডিএমএ টেকনোলজি।  কিন্তু অন্যান্য মোবাইল ফোন অপারেটররা হুট করেই আনল ব্যয়বহুল জিএসএম প্রযুক্তি। জিএসএম-এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়- ফোরজি ও ফাইভজিতেও বেশ ভালো সার্ভিস দেওয়া যায়। তখনই মাঠে এলো মুকেশ আম্বানির ‘রিলায়েন্স জিও’। জিও ভারতের পুরো বাজার দখল করে ফেলে। অনেক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেউলিয়া হয়ে যায় রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স। অনিল আম্বানির ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার সংকটের মুখে পড়ে। আইম্যাক্স বিগ সিনেমাকে তিনি তখন ‘কার্নিভ্যাল সিনেমা’র কাছে বিক্রি করে দেন। বিভিন্ন ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্টে টাকা ইনভেস্ট করে লসের মুখে পড়েন। ডিফেন্স সেক্টরে টাকা ঢেলেও লাভবান হতে পারেননি। এদিকে ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে তার। ঋণ শোধ করতে আস্তে আস্তে নিজের প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করা শুরু করেন অনিল। এভাবেই ধাক্কা খেতে খেতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অর্থবিত্তের সবটাই হারান। অনিল আম্বানির রিলায়েন্স টেলিকমিউনিকেশনের কাছে এরিকসনের পাওনা ছিল ৫৫০ কোটি রুপি। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে অনিল আম্বানিকে যেতে হবে কারাগারে। ভাইকে রক্ষা করেন মুকেশ আম্বানি। নিজে ৫৫০ কোটি রুপি দিয়ে দেন এরিকসনকে। ব্যাংক ঋণের জালে বারবার আদালতের মুখোমুখি হতে হয় অনিলকে। ভিডিও কলের মাধ্যমে লন্ডনের এক আদালতের শুনানিতে হাজির থাকতে হয়েছিল তাকে। তিনটি চীনা ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় তিনি বড় ধরনের বিপদে পড়েন। রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের কাছে ৭০ কোটি ডলার পাওনা আদায়ের জন্য মামলাটি করে এই ব্যাংকগুলো। আদালতের জেরার সময়ে অনিল আম্বানি জানান, তিনি দেউলিয়া হয়ে গেছেন।

 

যে কারণে দেউলিয়া অনিল

১. ভারতের সেরা টেলিকম কোম্পানি রিলায়েন্স কমিউনিকেশন। দারুণ ব্যবসা করছিল প্রতিষ্ঠানটি। এটিকে আরও শক্তিশালী ও বড় করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক আরেকটি টেলিকম কোম্পানি এমটিএন-এর সঙ্গে যোগ দেয় রিলায়েন্স। যার সঙ্গে বড় অঙ্কের ঋণও যোগ হয়ে টেলিকম ব্যবসায়। ব্যবসায় মারাত্মক এই ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে দিতে হয়েছে অনিল আম্বানিকে।

 

২. সময়টা তখন ২০০৪ সাল। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বেশ সখ্য গড়ে ওঠে অনিল আম্বানির। এক সময় নিজেও নাম লেখান রাজনীতিতে। ২০০৪-২০০৬ সালের মধ্যে স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে উত্তর প্রদেশ থেকে পালন করেন ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় দায়িত্ব। একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন রাজ কেলেঙ্কারিতে। ভারতীয় ২জি কেলেঙ্কারিতে সবার ওপরে আসে তার নাম। টেলিকম ব্যবসায় ২জি তরঙ্গ বিতরণ-সংক্রান্ত কেনাবেচায় কেলেঙ্কারির সূত্রপাত। বাদ যায়নি অনিলের রিলায়েন্স টেলিকমও। একে তো বড় ঋণের বোঝা, তার ওপর কেলেঙ্কারির অভিযোগ। মুখ ফিরিয়ে নেয় বড় বিনিয়োগকারীরা। অনিল আম্বানির শেয়ার দর এসে ঠেকে তলানিতে। আকাশ থেকে মাটিতে পড়েন তিনি।

 

৩. মাথায় বড় ঋণের বোঝা নিয়ে অনিলের অবস্থা তখন শোচনীয়। যে করেই হোক সে সময় প্রয়োজন পড়ে আরও বিনিয়োগের। ব্যবসা সামলাতে তো হবেই, পরিশোধ করতে হবে আগের ঋণও। এবার চীনের ঋণদাতা ব্যাংকের কাছে হাত পাতেন তিনি। নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি দায় রেখে চীনের ব্যাংক থেকে ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেন। যা শোধ করতে পারেননি। বারবার বলার পরও ঋণের কিস্তি শোধ না করায়, মামলা করে চীনের সেই ব্যাংক। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন অনিল।

 

৪. চুক্তি ছিল নির্দিষ্ট সময়ের আগে বড় ভাই মুকেশ আম্বানি টেলিকম ব্যবসায় আসবেন না। সে সময় পার হয়েছে। সময়টা ২০১৬ সাল, মুকেশ আম্বানি নাম লেখালেন টেলিকম ব্যবসায়। ভারতে আসলো ‘জিও’। অনিলের রিলায়েন্স যখন ধুঁকছে, ঋণের বোঝায় কাবু তখন জিও দুর্দান্ত ব্যবসা করছে। ধনীদের কাতার থেকে তত দিনে নাম কাটা গেছে অনিলের। মুকেশ আম্বানি হয়ে উঠেছেন দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ ধনী।

 

৫. মূলত ব্যবসায়িক উচ্চাভিলাষ, আর বেশ কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্ত অনিল আম্বানিকে ডুবিয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুলটি করেন টেলিকম ব্যবসায়। যেখানে আধুনিক বিশ্ব প্রযুক্তিতে নতুনত্ব যোগ করছে, সেখানে তিনি পুরনোয় আটকে ছিলেন। জিএসএম প্রযুক্তি গ্রহণ না করে সিডিএমএ প্রযুক্তিতে ভরসা করেন। আর ফোরজি-ফাইভজি টেকনোলজি আসার পর রিলায়েন্সের ব্যবসা তলানিতে এসে ঠেকে। এ ছাড়া ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি অসতর্ক ছিলেন। এক ঋণ শোধ করতে গিয়ে তিনি নিয়েছিলেন আরেকটি ঋণ।

 

বেছে বেছে বড় ব্যবসাগুলো নিয়েছিলেন সামলাতে পারেননি, সবই ডুবালেন

পৈতৃক সূত্রে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন দুই ভাই মুকেশ আম্বানি ও অনিল আম্বানি। পিতা ধীরুভাই আম্বানি মৃত্যুর সময় ২৫ হাজার কোটি রুপির বেশি সম্পদ রেখে যান। তবে ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে কিংবা কোন ছেলে কোন ব্যবসা সামলাবেন সে বিষয়ে ধীরুভাই আম্বানি কোনো নির্দেশনা দিয়ে যাননি। বেশ কয়েক বছর দুই ভাই একসঙ্গে সব ব্যবসার দেখাশোনা করলেও সেই সম্পর্কে অচিরেই চিড় ধরে। মনোমালিন্য দেখা দেয় নিজেদের মধ্যেই। দুই ছেলের বিবাদ মিটাতে এগিয়ে আসেন মা কোকিলাবেন আম্বানি। বাবার বিশাল সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়া হয় দুই ভাইয়ের মাঝে। বড় ভাই তেল, গ্যাস এবং উৎপাদিত সংস্থাগুলোর মালিকানা লাভ করেন। যদিও এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দেখাশোনা তিনি আগে থেকেই করতেন। আর এই ব্যবসাগুলো ছিল তুলনামূলক লাভজনক। অন্যদিকে অনিল আম্বানি পান ইলেকট্রিসিটি (বিদ্যুৎ উৎপাদন), টেলি কমিউনিকেশন (টেলিকম) এবং ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর (ব্যাংকিং খাত) মালিকানা। আর এই ব্যবসাগুলো ছিল তুলনামূলক কম লাভজনক। তবে সেগুলো ছিল বেশ সম্ভাবনাময় কিন্তু অনিল আম্বানি সেসব ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। বিলাসী ভাবনা আর ব্যবসা পরিচলনায় অদক্ষতা তাকে ধনী থেকে ফকির বানিয়ে দেয়। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ধনী অনিল পথে বসে যান।

 

একটি ঋণ পরিশোধের জন্য আরেকটি ঋণ গ্রহণ করেন অনিল

অনিল আম্বানির কোম্পানিগুলো একসময় সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছিল। ২০০০ শতকের গোড়ার সময় রিলায়েন্স কমিউনিকেশন ছিল সবার দোরগোড়ায়। ভারতীয়দের কাছে অত্যন্ত পরিচিত টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি ছিল রিলায়েন্স টেলিকম। আর ২০০৮ সালে অনিল আম্বানির কোম্পানিগুলোর বাজারমূল্য ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০১৯ সালে এই মূল্য মাত্র ২৩৯১ কোটি টাকায় নেমে আসে। ব্যাংক ঋণের ভারে চাপা পড়ে যাচ্ছিলেন অনিল আম্বানি। অনিল আম্বানি; যিনি ১০ বছর আগে পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম ধনী শিল্পপতি ছিলেন- তিনি এখন দারিদ্র্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন। কোম্পানি থেকেই দেউলিয়া হওয়ার পথ অনুসরণ করেন অনিল আম্বানি। রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস অর্থাৎ আরকম নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। বারবার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় আদালত তাকে ঋণ খেলাপি ঘোষণা করেন। তিনি প্রায় ৪৯ বার খেলাপি হয়েছেন। এক সময়ের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিটি নিঃস্ব হয়ে পথে বসেন।

 

গোপন সম্পদ নিয়ে কেলেঙ্কারি

কয়েক বছর আগে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন আম্বানি পরিবারের ছোট ছেলে অনিল আম্বানি। দেউলিয়া ঘোষণা করা সেই অনিল আম্বানির গোপন ১৮ কোম্পানি রয়েছে! তাও বিদেশে! এমন তথ্য প্রকাশ করে প্যান্ডোরা পেপারস। যারা সারা বিশ্বের নামিদামি ব্যক্তিদের গোপন সম্পদ, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের তথ্য প্রকাশ করে থাকে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনের আদালত তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। কারণ চীনের তিনটি ব্যাংকের দায়ের করা মামলার শুনানিতে আদালতে দাবি করেন তার সম্পদের পরিমাণ শূন্যে নেমে এসেছে। অনিল আম্বানি জানান, বিদেশে তার কোনো সম্পদ নেই। অথচ প্যান্ডোরা পেপারস বলছে অন্য কথা। রিলায়েন্স এডিএ গ্রুপের চেয়ারম্যান অনিল আম্বানি ও তার পক্ষের লোকদের মালিকানায় জার্সি, ভার্জিন আইল্যান্ড ও সাইপ্রাসে অন্তত ১৮টি অফশোর কোম্পানি রয়েছে। তন্মধ্যে সাতটি কোম্পানির ১৩০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও ঋণ রয়েছে। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০৭-১০ এর মধ্যে। জার্সিতে ব্যাটিস্টে আনলিমিটেড, রেডিয়াম আনলিমিটেড ও হুই ইনভেস্টমেন্ট আনলিমিটেড নামে ২০০৭-২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত তিনটি কোম্পানি রয়েছে।

 

তার সম্পদ বিক্রিতেও বাধা

কয়েক বছর আগে অনিল আম্বানি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। এবার রিলায়েন্স ইনফ্রাসট্রাকচার সংস্থা তাদের সম্পদ বিক্রি করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিল দিল্লি হাই কোর্ট। তিনি ভারত তথা এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির ছোট ভাই। মুকেশের ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানির বিবাহপূর্ব আসরে তার সম্পদের একটা ঝলক দেখা গেছে। বিভিন্ন দেশের ব্যবসায় আধিপত্য করছেন মুকেশ। অথচ অনিল আম্বানি একসময় বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন। তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ১.৮৩ লাখ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু সেই জায়গা থেকে মুখ থুবড়ে পড়েছেন তিনি। কয়েক বছর আগে অনিল আম্বানি নিজেকে দেউলিয়া বলে ঘোষণা করেছিলেন। রিলায়েন্স ইনফ্রাসট্রাকচারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১১০০ কোটি টাকারও বেশি। এই সম্পদ কোনোভাবেই অনিল আম্বানি বিক্রি করতে পারবেন না। ওই সম্পত্তি অন্য কোথাও স্থানান্তরও করা যাবে না। দিল্লি হাই কোর্ট বলেছে, চীনা সংস্থা ‘সাংহাই ইলেকট্রিক গ্রুপ’-এর সঙ্গে রিলায়েন্স ইনফ্রাসট্রাকচারের সালিশি বিরোধের জন্য নিরাপত্তা অর্থ হিসেবে এই ১১০০ কোটি টাকার সম্পদ জমা রাখতে হবে। এর আগে সাংহাই ইলেকট্রিক অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা অর্থ চেয়ে আবেদন করেছিল দিল্লি হাই কোর্টের একক বিচারকের বেঞ্চে। ২০২২ সালে একক বিচারকের বেঞ্চ সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল। রায়টিকে ডিভিশন বেঞ্চে চ্যালেঞ্জ করেছিল সাংহাই ইলেকট্রিক। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতেই এই রায় দিয়েছে দিল্লি হাই কোর্ট।

 

বড় ভাই এশিয়ার শীর্ষ ধনী ছোট ভাই ভিখারি

কদিন আগে মুম্বাইয়ের বাড়িতে ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানির বিবাহপূর্ব অনুষ্ঠান বেশ আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে পালন করেন ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানি। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা অতিথিদের জন্য পুরো আয়োজনে তিনি খরচ করেন প্রায় ১৬৫০ কোটি রুপি। মুকেশ আম্বানি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী। তার মোট সম্পদের পরিমাণ এখন প্রায় ১১৬.৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে তার ছোট ভাই অনিল আম্বানি আদালতে ঋণ খেলাপি হয়ে বারবার কারাগারে যাওয়া আশঙ্কায় দিন পার করেন। অবশেষে ঋণ খেলাপি রুখতে আদালতে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। একটা সময় ছিল- যখন অনিল আম্বানি ছিলেন বিশ্বের ষষ্ঠ ধনী শিল্পপতি কিন্তু আজ তিনি দেউলিয়া। পড়েছেন ব্যাংকের ভারী ঋণের বোঝার নিচে। অনিল আম্বানি প্রায় ৪৯ বার খেলাপি হয়েছেন। ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করা শুরু করেন। এভাবেই ধাক্কা খেতে খেতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অর্থবিত্তের সবটাই হারান। অনেক বিশ্লেষক  মনে করেন, অনিলের স্ত্রীর উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনও তার আজকের পরিণতির জন্য অনেকটা দায়ী।

 

বড় ভাই মুকেশের চেয়েও ধনী ছিলেন ছোট ভাই অনিল

একসময় ভারতের শীর্ষ ধনী ছিলেন অনিল আম্বানি। রিলায়েন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান। তার হাতে রয়েছে রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস, রিলায়েন্স ক্যাপিটাল, রিলায়েন্স ইনফ্রাসট্রাকচার, রিলায়েন্স পাওয়ার, রিলায়েন্স ডিফেন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড এবং রিলায়েন্স ডিফেন্স টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড। ফলে অনিল আম্বানির ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য বড় ভাই মুকেশ আম্বানিকে বরাবরই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত। ২০০৬ সালে পিতা ধীরুভাই আম্বানির মৃত্যুর পরও আম্বানি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। ফোর্বস অনুসারে, ভারতে অনিল আম্বানি তখন স্টিল টাইকুন লক্ষ্মী মিত্তাল এবং আজিম প্রেমজির পরে তৃতীয় ধনী ব্যক্তি ছিলেন অনিল আম্বানি। ২০০৭ সালে অনিলের মোট সম্পদ ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। অন্যদিকে সম্পদে এগিয়ে যান মুকেশ। ব্যবসায়িক মন্দায় পড়েন। লোকসান ঠেকাতে না পেরে একের পর এক ব্যবসার শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন অনিল। জড়িয়ে যান মামলায়। আজ এক ভাই এশিয়ার সবচেয়ে ধনী শিল্পপতি আর অন্য ভাই তার দেউলিয়া কোম্পানিগুলোর ঋণের বোঝা বহন করছেন। একটা সময় ছিল যখন অনিল আম্বানি ছিলেন বিশ্বের ষষ্ঠ ধনী শিল্পপতি কিন্তু আজ তিনি দেউলিয়া। পড়েছেন ব্যাংকের ভারি ঋণের বোঝার নিচে। অনিল আম্বানি প্রায় ৪৯ বার খেলাপি হয়েছেন।

 

দুই ভাইয়ের মধ্যে যেখানে পার্থক্য

২০০৮ সালে অনিল আম্বানি ২ বিলিয়ন ডলারসহ বিশ্বের ষষ্ঠ শীর্ষ ধনকুবেরের খেতাব অর্জন করেছিলেন। তবে দশক না পেরোতেই ২০১৯ সালে শীর্ষ দশে থাকা অনিল ভারতের শীর্ষ ধনীর তালিকায় ৭০-এর নিচে নেমে যান। এমনকি বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকা থেকেই (সেরা ১০০ ধনী) বাদ পড়ে যান। বিশ্বের ধনীদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল ১৩৪৯ নম্বরে। অনিল আম্বানির বাকি আছে ১.৭ বিলিয়ন ডলার। অনিল আম্বানি তার ভুলের জন্য সব হারিয়েছেন। ২০১৯ সালে যখন অনিল আম্বানির সম্পদ ১.৭ বিলিয়ন ডলার বাকি, সেই সময় মুকেশ আম্বানির সম্পদ ৫০ বিলিয়ন ডলার। দুই ভাইয়ের সম্পদে বিস্তর ফারাক। আর বর্তমানে মুকেশ আম্বানির মোট সম্পদের পরিমাণ ১১৬.৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে অনিল আম্বানি দেউলিয়া হয়েছেন।

 

বাবার বাড়িতে ঠাঁই হলো অনিলের

বড় ভাই মুকেশ আম্বানি (ভারতের শীর্ষ ধনবান ব্যক্তি) যে বাড়িতে থাকেন তার নাম ‘আন্তিলা’। ভবনটি ৪ লাখ বর্গফুট জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুম্বাইয়ের অভিজাত এলাকায়। ‘আন্তিলা’র ফ্লোর সংখ্যা ২৭। বাড়িটির উচ্চতা ১৭৩.১২ মিটার, যা একটি সাধারণ ৬০ তলা দালানের উচ্চতার সমান। অন্যদিকে অনিল আম্বানি থাকেন বাবা ধীরুভাই আম্বানির তৈরি করা বাড়িতে। এ বাড়িতে সুইমিং পুল, জিম, হেলিপ্যাড, পার্কিং স্পেস, গাড়ির সংগ্রহ প্রদর্শনের জন্য বড় লাউঞ্জ এলাকা সবই রয়েছে। অনিল আম্বানির বাড়ির বারান্দা থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায়। এটি বিলাসবহুল আকাশচুম্বী ১৭ তলা বিল্ডিং। ভবনটির উচ্চতা প্রায় ৬৬ মিটার। অনিল আম্বানি মূলত তার বাড়ির বিল্ডিংয়ের উচ্চতা ১৫০ মিটার বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে নির্মাণ কর্তৃপক্ষ বাড়িটির উচ্চতা বাড়াতে বাধা দেয়।

সর্বশেষ খবর