বুধবার, ২০ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

দেশে দেশে রকমারি ইফতারি

আবদুল কাদের

দেশে দেশে রকমারি ইফতারি

মহাসাগর এবং মহাদেশগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে করেছে আলাদা। তবে পবিত্র রমজান মাস বিশ্বজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে একত্রিত করে। মুসলমানরা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ভোরের আকাশের সোনালি আভা থেকে মাগরিবের আজানের আগ পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকে। সারা দিনের সংযম শেষে ইফতারের খাবারে থাকে নানা বৈচিত্র্য।  এই বৈচিত্র্যতা আবার দেশ-অঞ্চলভেদেও হয়ে থাকে আলাদা...

 

সারা বিশ্বের মুসলমানদের এক সুতোয় গেঁথেছে ইসলাম। প্রায় ১৪০০ বছর আগে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে রমজান মাসে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় দিনের বেলা ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা খাওয়া-দাওয়া, ধূমপান, মদ্যপান এবং শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে রমজান মাসের সওম বা রোজা পালন করা শুরু করে। প্রতি বছর ১০-১২ দিন আগে রমজান মাস শুরু হয়ে থাকে। এর কারণ, হিজরি বর্ষপঞ্জিকা হিসেবে সাধারণত ২৯ বা ৩০ দিনে আরবি মাস সম্পন্ন হয়ে থাকে। যেহেতু চাঁদ দেখার ওপর রমজান মাস নির্ভরশীল এবং প্রতি বছর গড়ে ১১ দিন কমে যায়- তাই ২০৩০ সালে পবিত্র রমজান মাস দুবার পালন করা হবে। প্রথমে ৫ জানুয়ারি তারপর ২৬ ডিসেম্বর রমজান মাস শুরু হবে। চলতি বছর ১২ মার্চের পর পরের বার মার্চ মাসে আবার রমজান মাস আসতে সময় লাগবে এখন থেকে ৩৩ বছর- অর্থাৎ ২০৫৭ সালে। যাই হোক, পবিত্র রমজান দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন আনে। স্বাভাবিক কর্মদিবসে নানা পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রতিদিনই দুটি ছোট উৎসব পালন করা হয়। এক. সাহরি এবং দুই. ইফতার। সাহরিতে যেমন তেমন হোক- কিন্তু ইফতারে বাহারি খাবারের পসরা না থাকলে যেন ইফতারের পূর্ণতা পায় না। বিশ্বজুড়ে স্থানভেদে রোজা পালনে ভিন্নতা না থাকলেও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রমজানের সংস্কৃতি অনেকটা আলাদা। সেই অনুযায়ী দেশে দেশে বাহারি সব খাবারের আয়োজন থাকে ইফতার কিংবা সাহরিতে। আজকে রকমারিতে আমরা জানব দেশে দেশে প্রচলিত কিংবা স্থানীয় বাহারি ইফতারের আয়োজন সম্পর্কে...

বাংলাদেশিদের ইফতারেও রয়েছে আলাদা খাদ্য সংস্কৃতি। আলুর চপ, বেগুনি, পিঁয়াজু, জিলাপি, হালিম, বিরিয়ানি, হরেক রকমের কাবাব ছাড়া যেন এই অঞ্চলের মুসলমানদের ইফতারটা ঠিক জমে উঠে না। কেবল বাংলাদেশ নয়, মুখোরোচক ভাজাপোড়ার স্বাদ নিয়ে থাকে উপমহাদেশের ভারত এবং পাকিস্তানের মুসলমানরাও। এর বাইরেও পাকিস্তানের ইফতারে শামি কাবাবের জায়গাটা যেন স্থির। তন্দুর রুটি বা চাপাটির সঙ্গে বেশ জুতসই। এ ছাড়া উপমহাদেশে মুঘলদের ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানির পরিবেশনা ছাড়া ভারতের মুসলিম প্রধান এলাকাগুলোর ইফতারি পরিবেশনা যেন অপূর্ণ। লক্ষেèৗ, কলকাতা, মোম্বাই, হায়দরাবাদী, সিন্ধি- বিরিয়ানির স্বাদ এক কথায় লাজবাব।  ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশীয় অনেক দেশে রুহ আফজা রমজান মাসের অবিচ্ছেদ্য পানীয়। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার মানুষের প্রধান খাদ্য আসিদা। অনেকটা পুডিং জাতীয় খাদ্য। লিবিয়ায় খেজুরের মিষ্টি রসের সিরায় আসিদা পরিবেশিত হয়। তিউনিসিয়ায় পাকা মরিচ আর গোলমরিচের ঝাল-ঝাল মিশ্রণের সঙ্গে মাখিয়ে খাওয়া হয়। ইথিওপিয়ানদের কাছে এই খাবারটিই জেনফো বা ওরোমো নামে পরিচিত। তবে ইয়েমেনিদের পরিবেশন সবার থেকে আলাদা। তারা আসিদার সঙ্গে প্রথমে টম্যাটোর একটি ঘন মিশ্রণ রাখে- যেটা ঝাল মসলায় তৈরি। তারপর আসিদার চারপাশে মুরগি কিংবা ভেড়ার মাংস সিদ্ধের পানি ছড়িয়ে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ অঞ্চলে ইফতারের আয়োজনে সুরুয়া জাতীয় খাদ্য ‘শরবা’ থাকে। এটি খেতে হয় রুটির সঙ্গে। তাবৌলে হলো একটি সালাদ জাতীয় খাদ্য। তৈরি হয় পার্সলে, টম্যাটো, পিঁয়াজ, শসা, সেদ্ধ করা বালজার গমে জলপাই তেল, নুন আর লেবুর রস মাখিয়ে। আক্রটিরি, সাইপ্রাস, ইসরায়েল, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনে এর জনপ্রিয়তা ব্যাপক। হরিরা, অনেকটাই বাংলার হালিমের মতো। এটি উত্তর আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী খাদ্য। কিন্তু মরক্কো ও আলজেরিয়াতেও বহুল জনপ্রিয়। এটা দিয়ে ইফতারির পরিবেশনা শুরু হয়। মাকলুবা, এক কথায় ইরাক, লেবানন আর জর্ডানের রুসুইঘরের মুখোরোচক একটি বিরিয়ানি। যেখানে মাংসের সঙ্গে থাকে ভাজা আলু, ফুলকপি, বেগুন আর টম্যাটোর মতো সবজির বাহার। মিসরের মাহশি হলো দোলমার মতোই একটা পদ। ধুন্দল (জুকিনি) কিংবা বেগুনের মাঝখানটায় গর্ত করে অন্য সবজি কিংবা মাংসের কিমা মসলা, এমনকি ভাত সহযোগে ভর্তি করা হয়। আরব্য অঞ্চলের জিভে জল আনা পদ মানসফ। ভেড়া বা ছাগলের দুধ এক ধরনের শক্ত দই তৈরি হয়, যাকে বলে জামিদ। যা মাখিয়ে দুম্বা, উট কিংবা ভেড়ার মাংস রান্না করা হয়। এটি জর্ডানের জাতীয় খাবার। মাংসের টুকরা মিলিয়ে গম সেদ্ধ করে রান্না হয় হারিস। এটি কাতারের জনপ্রিয় খাবার।

 

মিসর

ফারাওদের নগরী মিসর। এই অঞ্চলের ইফতারে ঠান্ডা পানীয় ও সতেজ ফলমূলের আছে আলাদা কদর। এ ছাড়াও চাল, মাংস ও মসলার সঙ্গে আঙুর লতা মিশিয়ে তৈরি হয় এক জনপ্রিয় খাবার। যদিও শুধু মিসরেই নয় পুরো আরবজুড়েই এই খাবার কিছুটা বৈচিত্র্যের সঙ্গে তৈরি করে খাওয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যের কুনাফা নামের মিষ্টিজাতীয় খাবারটিও মিসরে ইফতার হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বেশিরভাগ মিসরীয় রোজা ভাঙে বাদামি রুটির সঙ্গে ‘ফুল মেডামেস’ বা ফাভা বিনের তৈরি এক ধরনের তরকারিতে। পানীয়তে ব্যবহার করা হয় অ্যাপ্রিকট বা খুবানির খোসা।

 

ইরান

ইরানিরা ঐতিহ্যগতভাবে ইফতারে খেজুর সঙ্গে এক কাপ চা অথবা গরম পানি পান করেন। চা, রুটি, পনির, সতেজ শাক-সবজি খান তারা। এ ছাড়া মিষ্টির তালিকায় থাকে জুলবিয়া ও বামিহ নামের ২টি ঐতিহ্যবাহী পার্শিয়ান মিষ্টি। চিনির শিরাতে ডোবানো থাকে এই মিষ্টিগুলো। ইরানে তৈরি করা এক বিশেষ ধরনের স্যুপও ইফতারের সময় বেশ প্রচলিত। অ্যাশ রেশতেহ নামে এই স্যুপে থাকে চিকন নুডলস, দুগ্ধজাত মাঠার মতো জলীয় দ্রবণ এবং সঙ্গে পার্সলে, পালং, পিঁয়াজের মতো অন্যান্য উপাদান। বুটের ডাল ও মাংস দিয়ে তৈরি শামি কাবাবও সবার প্রিয়।

 

তুরস্ক

প্রাচীন অটোমান অর্থাৎ ওসমানিয়া শাসকদের তুরস্কে খাদ্য সংস্কৃতিতে শরবতের মর্যাদা ব্যাপক। ‘বাকলাভা’ নামের এক ধরনের মিষ্টান্নও ইফতারে তাদের বিশেষ পছন্দ। এ ছাড়াও তেঁতুলকে ৪১ রকমের মসলার সঙ্গে মিশিয়ে প্রায় আট ঘণ্টা জ্বাল দিয়ে একটি পানীয় তৈরি করা হয় তুরস্কে। সমগ্র বিশ্বে রোজায় ইফতারের শুরুটা খেজুর দিয়ে হলেও তুরস্কে নিয়মটা একটু আলাদা। তুর্কিরা সাধারণত জলপাই দিয়েও ইফতার শুরু করেন। সঙ্গে অনেকে খেজুরও খান। অন্যান্য খাবারের সঙ্গে ইফতারের আয়োজনে থাকে জলপাই-পনির দিয়ে তৈরি মিষ্টিজাতীয় খাবারও।

 

পাকিস্তান

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো রমজান মাসে ইফতারে পাকিস্তানিরাও বেশ ভোজনরসিক। তন্মধ্যে ভাজাপোড়ার পরিমাণও থাকে প্রচুর। সমুচা, তেলে ভাজা পাকোড়া, নিমকিজাতীয় নামাক পাড়া, ছোলা চাট, বিভিন্ন ধরনের কাবাব, দাহি ভাল্লা ইত্যাদি খাবার পাকিস্তানি ইফতারে বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়াও পানীয় হিসেবে রুহ আফজার কদর এ দেশে সবচেয়ে বেশি। অনেকে অবশ্য স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারও পছন্দ করেন। তাই ইফতারে পাকিস্তানির জনপ্রিয় খাবার চা মসলা দিয়ে তাজা ফলের সালাদ। এই খাবার তৈরিতে ফলগুলোকে কিউব কিউব করে কাটা হয়।

 

সৌদি আরব

সৌদি আরবে ইফতারে বিরিয়ানিজাতীয় লেবন হালিব ও মিষ্টিজাতীয় খাবার হারিসা কোনাফা খেয়ে থাকেন। মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি সালুনা নামের একটি খাবার থাকে সৌদির পূর্বাঞ্চলের ইফতারে। নানা ধরনের হালুয়া আরবের ইফতারে অন্যতম প্রধান বিষয়। এ ছাড়াও থাকে দুই ধরনের রুটি। বড় রুটিটিকে বলা হয় ‘তমিজ’, অপেক্ষাকৃত ছোট ও ভারী রুটির নাম ‘খবুজ’। থাকে ‘সাম্বুচা’ নামের একটি খাবারও। এ ছাড়া সুস্বাদু এক ধরনের সমুচায় মরিচ ছাড়াই মাংসের কিমা ভর্তি থাকে। সবখানেই যে উন্নত খেজুর আর জমজমের পানি থাকবে তা বলা বাহুল্য।

 

ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ায় একে বলা হয় ‘বুকা পুয়াসা’ বা রোজার উদ্বোধন, যা ইফতার নামে পরিচিত। সাধারণত এই অঞ্চলের লোকেরা প্রথমে একটি গরম বা ঠান্ডা পানীয় গ্রহণ করে। ১২ ঘণ্টার বেশি উপোস থাকার কারণে পেটকে ধীরে ধীরে খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এক ধরনের মিষ্টি পানীয় গ্রহণ করে তারা। এ ছাড়া রোজাদাররা খেজুরের সঙ্গে ওন্দে ওন্দে নামের এক ধরনের বড়ি দিয়ে ইফতার করেন। এটি সেখানকার রমজানের বিশেষ খাবার। এতে পান্ডন পাতা (যা কেওড়াপাতার মতো) পিষে খেজুরের রসের সঙ্গে মিশিয়ে তাতে নারকেল ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

 

মালদ্বীপ

মালদ্বীপের মুসলমানরা ক্রিমি নারকেল চালের পুডিং এবং ক্রেপস বা কিরু এবং ফলি দিয়ে ইফতার শুরু করে। এখানকার জনপ্রিয় খাবার কুলহি বোয়াকিবা। ঝাল ঝাল মাছের পিঠাজাতীয় খাবার এটি। ইফতারে তারা গারুধিয়া নামের একটি খাবার খেয়ে থাকেন। এটিও মাছের পদ। পরিবেশন করা হয় ভাত, লেবু, মরিচ ও পিঁয়াজ দিয়ে। চাল ও গরু বা খাসির মাংস দিয়ে বানানো আরেকটি খাবার তারা ইফতারে গ্রহণ করেন। এর নাম থারিদ। মালদ্বীপের ফিশ কেক, ফিশ বল, সামোসা, ফিশ রোল, কাটলেট বেশ জনপ্রিয়। মসলাদার আলু এবং টুনা কাটলেট সবার প্রিয়।

সর্বশেষ খবর