দূরে বরফের চাদরে মোড়া জাবারওয়ান পর্বতশ্রেণি। কাছে মেঘ ছোঁয়া শঙ্করাচার্য পাহাড়। পেছনে লাগোয়া বিশাল ডাল হ্রদ। সামনে বিস্তৃত বাগান, চারপাশে সবুজ ভূমিতে বড় বড় চিনার গাছ। এমন মনোরম প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বড় গম্বুজ আর উঁচু মিনারের ধবধবে সাদা মার্বেল পাথরের অসাধারণ সুন্দর মসজিদটি। স্থাপত্য সৌন্দর্য আর পবিত্রতায় চোখ-মন জুড়িয়ে যায়।
হজরতবাল মসজিদ, ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীরের ঐতিহাসিক ও পবিত্রতম মুসলিম তীর্থস্থান। ভারতের জনপ্রিয় তীর্থস্থানগুলোর অন্যতম, সারা বিশ্বের মুসলমানদের আকর্ষণ। কাশ্মীরি মুসলিমদের কাছে ‘দরগাহ শরিফ’ নামে সম্মানিত, এখানে সংরক্ষিত আছে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাড়ির পবিত্র চুল বা ‘মোই-ই-মুক্কাদাস’। এ পবিত্র নিদর্শনের জন্যই মুসলমানদের কাছে খুবই উচ্চ শ্রদ্ধা আর মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা-ভক্তির প্রতীক এ দরগাহ-মসজিদ। উর্দু ‘হজরত’ অর্থ শ্রদ্ধেয় ও হিন্দি ‘বাল’অর্থ ‘চুল; এর যৌগিক সম্মিলনে ‘হজরতবাল’নামকরণ। মদিনাতুস-সানি (দ্বিতীয় মদিনা) ও আসার-ই-শরিফ নামেও আলাদা পরিচিত আছে। এছাড়াও হিন্দু-শিখসহ কাশ্মীরের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষেরও তীর্থস্থান এ দরগাহ, যেখানে তারা আধ্যাত্মিক সান্ত¡না খুঁজে পান। এতে কাশ্মীর উপত্যকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে হজরতবাল দরগাহ। সমৃদ্ধ ইতিহাস আর মনকাড়া স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিশ্ব পর্যটকদেরও কাছে টানছে। সব মিলিয়ে বছরজুড়ে লাখ লাখ দর্শনার্থীর সাক্ষী হচ্ছে এই দরগাহ-মসজিদ।
গত বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে কাশ্মীরে আমাদের ৬ দিনের সফরটা শুরু হয়েছিল এ তীর্থস্থান দিয়েই। গিয়েছিলাম চট্টগ্রামের ডায়মন্ড সিমেন্টের ৩৪ সদস্যের পরিব্রাজক দলের সঙ্গী হয়ে, আকাশপথে ঢাকা থেকে দিল্লি হয়ে শ্রীনগর। ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে গ্রুপ প্যাকেজ, থাকা-খাওয়া-বেড়ানো সবকিছুই ছিল নিয়মবাঁধা। প্রথম দিন কাটে শ্রীগরের ইতিহাস-প্রকৃতির সান্নিধ্যে, যেখানে স্থাপত্যশৈলীর অপূর্বতার সঙ্গে আত্মিক প্রশান্তিতে মন বাধে হজরতবাল মসজিদ। তুলে ধরছি আদ্যোপ্রান্ত, শুরুতেই ইতিহাস।হজরতবাল মসজিদের একটি চমকপ্রদ ইতিহাস রয়েছে, যা ১৭ শতকের গোড়ার দিকে নিয়ে যায়। কাশ্মীর পর্যটনের তথ্য বাতায়ন আর বিভিন্ন প্রবন্ধ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে মসজিদটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটি ছিল ‘ইশরাত মহল’। ১৬২৩ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলের সুবেদার সাদিক খান ‘আনন্দঘর’ হিসেবে বিশাল বাগানসহ মহলটি বানিয়েছিলেন। ১৬৩৪ সালে, সম্রাট শাহজাহান বেড়াতে এসে মহলটিকে উপাসনালয়ে রূপান্তরের আদেশ দেন। তখন মিহরাব-মিম্বার বানিয়ে নামাজঘর করা হয়। ১৭০০ সালে কাশ্মীরি ধনী ব্যবসায়ী খাজা নূর-উদ-দ্বীন ঈসায়ীর মেয়ে ইনায়েত বেগম ‘হজরতবাল দরগাহ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যখন তিনি নবীজি (সা.)-এর পবিত্র নিদর্শনের রক্ষক হন। তা ছিল মুঘল ও কাশ্মীরি স্থাপত্যের মিশ্রণে সুন্দর স্থাপনা। সাতটি জানালাসহ তিনতলা ভবনটিতে প্যাগোডা শৈলীর পাঁচটি ছাদ ছিল।
হজরতবাল মসজিদের পেছনের দিক, সামনে দাঁড়িয়ে লেখক
সেই পুরানো ভবন ভেঙেই বর্তমান মার্বেল কাঠামোর নতুন মসজিদটি বানানো হয়। কাশ্মীরের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে জম্মু ও কাশ্মীর মুসলিম ওয়াকফ ট্রাস্ট এ উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল প্রায় ১১ বছর নির্মাণ কাজ চলে। এ সময় উপত্যকায় ইসলামিক শিল্পের সূচনা হয়েছিল, ফলে নতুন নির্মাণের স্থাপত্যেশৈলী পুরনোটির চেয়ে অনেক আলাদা হয়। শেখ মোহাম্মদ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, পরে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর ছেলে ফারুক আবদুল্লাহ ও নাতি ওমর আবদুল্লাহও দীর্ঘ সময় কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, যাদের সম্পর্কে আমাদের কমবেশি জানা আছে।
শ্রীনগরের শেখ-উল-আলম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সাড়ে ১৮ কিমি আর শহরকেন্দ্র থেকে ৮ কি.মি দূরে ডাল লেকের শেষ প্রান্তে পশ্চিমতীর ঘেঁষে হজরতবাল মসজিদ। আমরা গিয়েছিলাম শহর কেন্দ্রের বিখ্যাত লালচক এলাকার হোটেল থেকে, জিপে সময় নেয় ২০ মিনিট। প্রধান গেট ছাড়িয়ে স্থানীয় বাজারের লাগোয়া বামপাশের গেটের সামনে থামে আমাদের গাড়ি বহর। সুন্দর জ্যামিতিক কারুকাজ করা মার্বেল পাথরের বড়-ছোট দুটি গেট। দলনেতা হাকিম আলী ভাইয়ের সঙ্গে খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরের চত্বরে। মুখেই স্বাগত জানায়, উচ্ছ্বসিত কবুতরের ঝাঁক, শত শত কবুতর - যেন জানান দিচ্ছি, বার বার রক্তাক্ত ভূস্বর্গে ফিরে এসেছে শান্তি!
নিরাপত্তা ডিটেক্টর চৌকাঠ পেরিয়ে মসজিদের স্টিলের শেডের করিডোর, মেঝে জুড়ে সবুজ গালিচা, শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন পুণ্যার্থীদের অনেকে। করিডোর পেরিয়ে ঢুকলাম মসজিদের বামপাশের বাড়তি অংশে। বিশাল পরিসরের এ অংশে সামনের-পিছনের দেয়াল কাচ লাগানো ফ্রেমে খিলানশৈলীর বড় বড় জানালা দেওয়া। দুপাশের প্রবেশপথও খিলানশৈলীর। মেঝেতে কারুকাজের লাল কার্পেট। উপরে ছোট বক্স আকৃতির ওয়াফেলশৈলীর সিলিংটা বেশ নজর কাড়ে। তারপর সোজা ঢুকে গেলাম মসজিদের মূল অংশে। অনেক উপরে মার্বেল পাথরের বিশাল গোলাকার গম্বুজ। ভেতরটা কাঠকে একত্রিত করে জ্যামিতিক আকৃতির শিলিং লাগানো, জেনেছি এগুলো কাশ্মীরের দামি খাতম ব্যান্ডের শিলিং। গম্বুজের মাঝখান থেকে বড় একটি সুন্দর ঝাড়বাতি ঝোলানো, এর নিচে চারপাশে রয়েছে আরও ৪টি ছোট ঝাড়বাতি। চারপাশের দেওয়াল কাশ্মীরি স্থাপত্যশৈলীর ফলস সুন্দর কাঠের ফ্রেমে সাজানো। মেঝেতে বিছানো নজরকাড়া কার্পেট। কিবলামুখী খিলানযুক্ত মিহরাবটি দেখতে বেশ সুন্দর। মিহরাবের উপরে দেওয়ালে লাগানো কাঠের ফ্রেমে কাচের বড় আকারের দৃষ্টিনন্দন বাক্স। তালা লাগানো এই বাক্সেই সিলভার পেন্ডুলামের সঙ্গে একটি কাচের টিউবে রাখা আছে নবীজি (সা.)-এর চুলের পবিত্র নিদর্শন।
মিহরাবের ওপরে দেয়ালে লাগানো বাক্সে রাখা মহানবীর (সা.) চুলের পবিত্র নির্দশন। ছবি : লেখক
নবীজি (সা.)-এর পবিত্র চুল কাশ্মীরে পৌঁছার গল্পটাও বেশ আকর্ষণীয়। কিংবদন্তি অনুসারে, ১৬৩৬ সালে ভারতজুড়ে যখন ইসলামি মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার, নবীজির বংশধর ও সৈয়দ আবদুল্লাহ মাদানি মদিনা ছেড়ে ভারত আসেন। তিনি পবিত্র মসজিদে নববির ট্রাস্টিও ছিলেন। তাঁর কাছে ছিল তিনটি পবিত্র নিদর্শন। নবীজির দাড়ির চুল, হজরত আলীর পাগড়ি ও ঘোড়ার জিন (জুল জালাল)। তিনি কর্নাটক রাজ্যের বিজাপুরে বসতি গড়েন। পরে তিনি কাশ্মীরে থিতু হন, সঙ্গে নিয়ে আসেন নবীজি (সা.)-এর নিদর্শনটি। তাঁর মৃত্যুর পর, ছেলে সৈয়দ হামিদ পবিত্র নিদর্শনের মোতওয়ালি (রক্ষক) হন। এর কিছুদিন পরেই মুঘলরা কাশ্মীর অঞ্চল জয় করে নেয়। এ সময় সৈয়দ হামিদের পারিবারিক সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে নবীজি (সা.)-এর পবিত্র স্মৃতিচিহ্নটি যত্ন নিতে অক্ষম হয়ে সৈয়দ হামিদ কাশ্মীরের ধনী ব্যবসায়ী খাজা নূর-উদ-দ্বীন ঈসায়ীকে দিয়ে দেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব নিদর্শনের অস্তিত্ব ও স্থানান্তরের বিষয়ে জানতে পেরে তা বাজেয়াপ্ত করেন। পরে আজমিরে হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) দরগাহে পাঠিয়ে দেন এবং ঈসায়ীকে দিল্লিতে বন্দি করা হয়। নয় দিন পর আওরঙ্গজেব নবীজিকে স্বপ্নে দেখেন, নির্দেশ পান মোই-ই-মুকাদ্দাস কাশ্মীরে ফিরে দেওয়ার। সম্রাট পবিত্র নিদর্শনটি ফিরিয়ে দিয়ে ঈসায়ীকে কাশ্মীরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। কিন্তু ততক্ষণে কারাগারে মারা যান ঈসায়ী।
১৭০০ সালের দিকে, ঈসায়ীর মরদেহের সঙ্গে নবীজি (সা.)-এর পবিত্র চুল কাশ্মীরে আবার ফিরে আসে। ঈসায়ীর মেয়ে ইনায়েত বেগম পবিত্র নিদর্শনের রক্ষক হন। তিনি হজরতবাল দরগায় তা সংরক্ষণ করেন। এর আগে কিছু সময়ের জন্য শ্রীনগরের কেন্দ্রে ‘জিয়ারত নকশবন্দি সাহাব’ দরগায় রাখা হয়েছিল। দর্শনার্থীদের বিশাল ভিড়ের তুলনায় জায়গাটি বেশ ছোট হওয়ায় হজরতবালে স্থানান্তর করা হয় নবীজির স্মৃতিচিহ্ন। নিদর্শনটি ইনায়েত বেগমের স্বামীর পরিবারের পুরুষ বংশধররা (বন্দে পরিবার) তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দেখভাল করে আসছেন। তত্ত্বাবধায়করা ‘নিশানদেহদ নামে পরিচিত।
এ পবিত্র নিদর্শন দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। কারণ, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), শবেমেরাজ, চার প্রধান খলিফার জন্মদিনের মতো বিশেষ দিনেই দর্শনার্থীদের সামনে আনা হয়। জানা যায়, একজন তত্ত্বাবধায়ক হাতে নিয়ে নবীজির চুলের কাচের টিউবটি সবার সামনে তুলে ধরেন। এই সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন ধর্মপ্রাণ দর্শনার্থীরা, পবিত্র স্মৃতিচিহ্নের আভাসে চোখ ভেসে যায় জলে। পবিত্র কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে আল্লাহর দরবারে হাত তোলেন সবাই। এমন দিনে নারী-পুরুষ মিলিয়ে লাখেরও বেশি পুণ্যার্থীর বিশাল সমাবেশের সাক্ষী হয় হজরতবাল। যাদের মধ্যে অন্য ধর্মের হাজারো মানুষও থাকেন। দেখতে না পারলেও এমন দুর্লভ নিদর্শনের কাছে যেতে পারায় শিহরিত হয়েছে আমাদের দলের সবাই।
জোহর ও আসরের মাঝামাঝি সময়, মসজিদ একেবারে ফাঁকা। আমাদের দলের বাইরে হাতেগোনা কয়েকজন পর্যটক ইবাদতে ব্যস্ত। আমরা দুই রাকাত নফল নামাজের সঙ্গে জিয়ারত করলাম। পরে আসরের কছর নামাজও পড়ে নিলাম। মসজিদের মূল অংশে মহিলাদের প্রবেশের অনুমতি নেই, তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। আমাদের দলে থাকা দুজন নারী সদস্য, দলনেতা হাকিম ভাই ও বয়োজ্যেষ্ঠ কাশেম তালুকদার ভাইয়ের সহধর্মিণীরা সেখানেই ইবাদত করেন। মসজিদের ডানদিকের অংশটিও বাম দিকের মতো সাজানো। পেছনে রয়েছে একটি সুন্দর হাম্মাম (তুর্কি গোসলখানা)। আমরা অজু সেখানেই করেছিলাম।
মসজিদ থেকে বের হয়ে পিছনের দিকে ডাল হ্রদের সান্নিধ্যে কাটিয়েছিলাম কিছু সময়। ‘কাশ্মীরের মুকুটে রত্ন’ খ্যাত হ্রদের সৌন্দর্য ও পরিবেশ মুগ্ধতা ছড়ায়, ছবিতে ছবিতে স্মৃতি ধরে সবাই। পাশের স্থানীয় বাজারেও ঢুঁ মেরেছিল সহযাত্রীদের অনেকে। ছোট ছোট দোকানে কাশ্মীরি শাল, কাপড় ছাড়াও স্থানীয় স্বাদের নানাপদের খাবার পাওয়া যায়। বিশাল থালায় রাখা অনেক বড় আকারের পরোটা আর হালুয়াই টানে আমাদের, স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে! সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় অনেক বেশি মহিমান্বিত দেখায় হজরতবাল মসজিদ। তবে এ সময় মানুষের ভিড় বেশি থাকে, বিশেষ করে সন্ধ্যায় মাগরিবের সময়। ফজর নামাজ থেকে এশার নামাজ পর্যন্ত মূল অংশ খোলা থাকে।
বড় প্রশান্তিটা আসে, যখন সফরসূচির বাইরে পবিত্র মসজিদে বিশাল জামাতে জুমার নামাজ পড়ার সৌভাগ্যটা ধরা দেয়। পঞ্চম দিন শুক্রবার দূরের নির্ধারিত গন্তব্যে বাতিল হওয়ায় হজরতবালে জুমা পড়ার সুযোগ হয়। আমরা দুপুর ১টায় পৌঁছে যাই। কাশ্মীরি, উর্দু, আরবিতে খতিবের বয়ান ও খুতবা শেষে জামাত দাঁড়ায় আড়াইটায়। নামাজের পর লম্বা মোনাজাত, শেষ হতে ৩টা পেরিয়ে যায়। মসজিদের বাইরেও আশপাশের বিশাল এলাকা মুসল্লিরা কাতারে শামিল হন। একজন খাদেমের মতে, ৫০ হাজারের বেশি মুসল্লি জুমা আদায় করেন। সব মিলিয়ে অন্যরকম অভিজ্ঞতা-অনুভূতি ছিল আমাদের দলের কমবেশি সবার। সহযাত্রী মাকসুদ ভাই যেমনটি বলেন, ‘এমন একটা পবিত্র মসজিদে জুমার নামাজ আদায় সত্যিই সৌভাগ্যের বিষয়। প্রশান্তিতে মনটা জুড়িয়ে যায়’। মনসুর ভাইয়ের মতে, ‘লম্বা মোনাজাত একেবারেই ব্যতিক্রম। অনেকে দেশে জুমার নামাজ পড়ার অভিজ্ঞতা আছে। এমন দীর্ঘ সময়ের মোনাজাত কখনো পাইনি।’
ইতিহাস বলছে, নবীজির পবিত্র নিদর্শনের ওপর একবার কালো থাবা পড়েছিল। ১৯৬৩ সালের ২৬ ডিসেম্বরে লোহার ব্লেডে ডাবল তালা ভেঙে চুরি করা হয়। এ ঘটনায় ফুঁসে ওঠে কাশ্মীর, বিক্ষোভে রাস্তায় নামে হাজার হাজার মানুষ। উত্তপ্ত কাশ্মীরের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) ব্যাপক উত্তেজনা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নেয়। অনেক হতাহতের সে দাঙ্গা ‘গণহত্যা ১৯৬৪’ নামে ইতিহাসের পাতায় উঠে। এক সপ্তাহ পরে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি পবিত্র নিদর্শন উদ্ধার হয়। কাশ্মীরের আধ্যাত্মিক নেতা ও সুফি কবি সৈয়দ মিরক শাহ কাশানিসহ তত্ত্বাবধায়কদের বিশেষ শনাক্তকারী দল পবিত্র নিদর্শনের সত্যতা নিশ্চিত করেন। সে সময়ের পন্ডিত জওহরলাল নেহরু সরকার লোকসভাকে জানায়, তত্ত্বাবধায়কদের একজন নিদর্শনটি চুরি করেছিলেন। উত্তেজনা দেখে নিদর্শনটি ফিরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেফতার হন। ধর্মীয় গুরুত্ব ছাড়াও, হজরতবাল দরগাহ-মসজিদ। এক সময় কাশ্মীরের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিল, বাদ থাকেনি ভূস্বর্গের রক্তাক্ত অধ্যায় থেকেও। সে অনেক লম্বা ইতিহাস। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, পরিবেশ পুরোপুরি শান্ত। কাশ্মীরিদের পাশে বিশ্ব পুণ্যার্থী-পর্যটকরাও নিশ্চিন্তে যেতে পারছেন।
জুমার নামাজ শেষে আমি বের হয়েছিলাম মসজিদের সামনের বিশাল উদ্যান পেরিয়ে প্রধান গেট দিয়ে। সবুজ উদ্যানে চিনার গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছেন পুণ্যার্থীরা। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), শবেমেরাজের বিশেষ দিনে লোকারণ্য থাকে এ উদ্যান। নবীজির পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন এক নজর দেখার জন্য এক ঝলকের অপেক্ষার প্রহর গোনেন ভক্তরা। ফকির-ই-মিলাত নামে পরিচিত সুফি কবি সৈয়দ মিরক শাহ কাশানি কবিতায় বলে গেছেন, ‘উদ্যানটি মুহাম্মদের আলোয় উজ্জ্বল, প্রতিটি ফুল ও গাছে প্রতিফলিত হয় মুহাম্মদের আলো’।
লেখক : সাংবাদিক