সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা
যে সাগরে কেউ ডোবে না

রহস্যেঘেরা মৃত সাগর

তানভীর আহমেদ

রহস্যেঘেরা মৃত সাগর

এ সাগরে কিছু ডোবে না কেন ?

যুগে যুগে মানুষের সামনে বড় একটি প্রশ্ন ছিল, কেন মৃত সাগরে মানুষ ডোবে না? আসলে পানিতে লবণ বেশি থাকায় ডুবে যায় না মানুষের শরীর। বরং ডুব দিতে চাইলে কষ্ট করে দিতে হয়। কেউ ইচ্ছা করলে এই পানিতে দিব্যি গা এলিয়ে দিয়ে ভেসে থাকতে পারে ঠিক সোলার মতো। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মহাসাগরে পানির সঙ্গে ডেড সির পানিতে মিশে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর যথেষ্ট পার্থক্য আছে।  মৃত সাগরের পানিতে মিশে থাকা লবণে ১৪% ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ৪% পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ৫০% ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে। এর লবণাক্ততা স্বাভাবিক সাগরের থেকে ৮.৬ গুণ বেশি।  শতকরা হিসেবে ৩০ ভাগ। ফলে পানির ঘনত্ব ১.২৪ কেজি/লিটার। এসব উপাদানের কারণে ডেড সির পানির প্লাবতা শক্তি পৃথিবীর অন্য স্থানের পানির চেয়ে অনেক বেশি। আর এই উচ্চ প্লাবতা শক্তির কারণে এই সাগরে কোনো কিছু ডোবে না।

 

রহস্যের শেষ নেই

পৃথিবীতে রহস্যের শেষ নেই। এসব রহস্য মানুষের মনে কৌতূহল তৈরি করে। পৃথিবীর অনেক রহস্যেরই কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি মানুষ। আবার অনেক রহস্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে অনেক রহস্য আসলে মিথেই ভরপুর। ডেড সি বা মৃত সাগর নিয়ে কালে কালে কম রহস্যের ঘূর্ণিপাক ঘটেনি। নামে সমুদ্র হলেও ডেড সি আসলে একটি হ্রদ। ডেড সি-কে নিয়ে মানুষের এত কৌতূহলের কারণ আর কিছুই নয়। পানিতে মানুষ ডুবে গেলেও ডেড সি বা মৃত সাগর এমন একটি সাগর যে সাগরের পানিতে কেউ ডোবে না। ডেড সির পশ্চিমে পশ্চিমতীর এবং ইসরায়েল, পূর্বে জর্ডান অবস্থিত। মৃত সাগর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২০ মিটার বা ১ হাজার ৩৭৮ ফুট নিচে অবস্থিত। এন্ডোরেয়িক হাইপার-স্যালাইন ধরনের এই সাগরের পানির প্রধান উৎস জর্ডান নদী। এই সাগরের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৬৭ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৮ কিলোমিটার। এ স্থানটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নতম স্থান বা স্থলভূমি। প্রায় তিন মিলিয়ন বছর আগে বর্তমান জর্ডান নদী, মৃত সাগর এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরের পানিতে বারবার প্লাবিত হতো। এর ফলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটি জেজরিল উপত্যকায় একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

৭০ হাজার বছর পূর্ব থেকে ১২ হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত ডেড সির পানির উচ্চতা বর্তমান উচ্চতার চেয়ে ১০০ থেকে ২৫০ মিটার বেশি ছিল। ২৬ হাজার বছর আগে এটির পানি সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে যায়। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে এর পৃষ্ঠ উচ্চতা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে, যা সম্ভবত বর্তমান পৃষ্ঠ উচ্চতার চেয়েও কম ছিল। গত কয়েক হাজার বছর ধরে এর পানির পৃষ্ঠ উচ্চতা মোটামুটি ৪০০ মিটারের আশপাশে অবস্থান করছে। পৃথিবীর সব খাল, বিল, পুকুর, নদী, সাগরের পানিতে মানুষসহ যে কোনো জিনিস সহজেই ডুবে যায় কিন্তু ডেড সির পানিতে ডোবে না কেন? এ রহস্যই মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। প্রাচীনকালে মিথ ছিল-এটি একটি অভিশপ্ত স্থান। আসলেই কি তাই?

 

রয়েছে হাজার বছরের মিথ

মৃত সাগর নিয়ে বহু মিথ প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে এখানে কোনো মাছ নেই। কোনো গাছ নেই। সাগর নাকি মানুষকে গিলে ফেলে-আরও কত কী! ডেড সি নিয়ে মানুষের কৌতূহলের বাড়াবাড়ি থেকেই আসলে এ ধরনের গুজব ছড়িয়েছে। এই সাগরের কিন্তু আরও কয়েকটি নাম আছে। যেমন : ‘সি অব সোডোম’, ‘সি অব লট’, ‘সি অব অ্যাসফ্যাল্ট’, ‘স্টিংকিং সি’, ‘ডেভিলস সি’। আগে এই সাগরকে ঘিরে মানুষ নানা কাল্পনিক কাহিনি তৈরি করেছিল। অনেকে মনে করতেন এই সাগরে শয়তান আছে, নয়তো শয়তানের অভিশাপ আছে, তা না হলে পানি আছে, মাছ নেই, এ কেমন করে হয়? আর তাই তারা এর নাম দিয়েছিলেন ডেভিলস সি। আবার এই সাগরের তীরেই ছিল সোডোম নামের একটি শহর। সেখান থেকেই এর নাম দেওয়া হলো সি অব সোডোম। এমনি প্রত্যেকটা নামের পেছনেও অনেক গল্প আছে। এখানে যে শুধু এই অদ্ভুতুড়ে হ্রদই আছে তা না, আছে অদ্ভুতুড়ে কিছু গাছও, যেগুলো পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। তবে বাস্তবিক অর্থে ডেড সির অভ্যন্তরে বেশ কিছু বিশেষ প্রজাতির মাছ রয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু বিজ্ঞানী পানির একেবারে নিচে কোনো ঝরনা থেকে আসা মিষ্টি পানিতে কিছু ব্যাকটেরিয়া জাতীয় প্রাণীর সন্ধান পেয়েছেন। এছাড়া সেখানে উদ্ভিদের দেখাও মিলেছে। আর মানুষ তো হরহামেশাই ডেড সিতে বেড়াতে যাচ্ছে। পর্যটকদের কাছে প্রিয় এই স্পট। ডেড সির পানির ওপর বসে মানুষ হাওয়া খেতে পারে না ডুবেই। ভূ-মধ্যসাগরের সমতলের ১৩০২ ফুট নিচে রয়েছে ডেড সির সমতল। লবণে ভরা এমন পানিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘ব্রাইন’। ২০০১ সালে মৃত সাগর থেকে পাওয়া ব্রাইন দিয়ে ইসরায়েল প্রায় দুই মিলিয়ন টন পটাশ, ৪৪ হাজার ৯০০ টন কস্টিক সোডা, ২০ হাজার ৬০০ টন ব্রোমিন, ২৫ হাজার টন ম্যাগনেসিয়াম এবং সোডিয়াম ক্লোরাইড উৎপাদন করে। আর এই লবণ তোলার জন্য কাজ করছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ মানুষ। এর চেয়ে নিচে পানির সমতল পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

 

মরতে বসেছে ডেড সি

পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ টালমাটাল হয়ে উঠেছে। যার প্রভাব পড়েছে ডেড সির উপরেও। জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোটি স্টেইনের দাবি, হয়তো আর এক যুগ, হয়তোবা তা-ও নয়। এর চেয়েও কম টিকে থাকবে ডেড সি। সানফ্রান্সিসকোয় আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মলনে এ হুঁশিয়ারিই দেন তিনি। আগামী কয়েক বছর যদি খরার মুখে পড়ে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো, তাহলে হয়তো সত্যিকার অর্থেই মরে যাবে ‘ডেড সি’। হ্রদের পানির প্রধান উৎস জর্ডান নদী। খাল কেটে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নদীর পানি। চলছে সেচের কাজ। তাহলে কী করে ভালো থাকে ‘ডেড সি’। এখন হ্রদকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় ‘পানির জোগান’ অব্যাহত রাখা। সেচের কাজে ‘হ্রদের’ অবাধ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর