রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

দেশে দেশে পানির অভাব

আবদুল কাদের

দেশে দেশে পানির অভাব

বোগোটার সান রাফায়েল জলাধার; যা শহরের পানির উৎস। ‘এল নিনো’ জলবায়ুর প্রভাবে পানি এখন নিম্নস্তরে...

পানির জন্য জীবন। এই পানি আবার একটি জটিল সমস্যা। অর্থাৎ পানির অভাব। কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হলেও বাড়তি উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘এল নিনো’। যা সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। মূলত সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা স্বাভাবিকের চেয়ে ছাড়িয়ে গেলে ‘এল নিনো’ হয়। ফলে বাড়তে থাকে গরমের তীব্রতা। প্রচণ্ড দাবদাহ মানুষের ভোগান্তিতে রূপ নেয়। এমনিতে বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়- বৈশ্বিক পানি সংকটের প্রধান কারণ। এর মধ্যে ‘এল নিনো’র বছর হওয়ায় সংকট ভোগান্তিতে রূপ নিচ্ছে।  বর্তমান বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ মানুষ পানির সংকট এবং অভাবের মুখোমুখি। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। ফলে আরও ১০০ কোটির বেশি মানুষ পানির অভাবের মুখোমুখি হবে...

 

 ৯০ লাখ মানুষের পানি সংকট এড়াতে রেশনিং পদ্ধতি!

আমেরিকান কার্টুনিস্ট ম্যাট গ্রোইনিংয়ের অ্যানিমেটেড সিরিজ ‘দ্য সিম্পসনস’-এর সুপারভিলেন চরিত্র সি. মন্টগোমারি বার্নসের একটি দৃশ্য- দরজায় একগুচ্ছ লাল গোলাপ এবং হার্ট (হৃদয়) আকৃতির নিয়ে দাঁড়িয়ে মি. বার্নস। মুচকি হেসে বলছেন, ‘আমি দেখেছি আপনার পানিবণ্টনের ধরন (রেশনিং), আমার চেয়ে আলাদা।’ সম্প্রতি কলম্বিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন মিম দৃশ্য ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হচ্ছে, কারণ দেশটির রাজধানী শহর বোগোটা দেখছে প্রচণ্ড পানির সংকট।

 

ভয়াবহ খরায় এ অঞ্চলের জলাধারের পানি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নস্তরে নেমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ৯০ লাখ জনসংখ্যার রাজধানী শহরে পানি ব্যবহার সীমিত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি (৮ এপ্রিল, সোমবার) কলম্বিয়ার বোগোটা শহর কর্তৃপক্ষ পানিবণ্টনের ঘোষণার পর শহরের নাগরিকরা হাস্যরসেভরা এই মিম দৃশ্য শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘এল নিনোর মতো দাবদাহের বছরে জলাধারগুলো খরায় শুকিয়ে যাবে। আর মানুষকে বেঁচে থাকতে পানিসম্পদকে  বণ্টন (রেশনিং) করতে হবে।’

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বোগোটা ও এর আশপাশের কয়েক ডজন এলাকাকে নয়টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে ২৪ ঘণ্টা করে পানি সরবরাহ সেবা বন্ধ রাখা হবে। যা সেসব অঞ্চলে প্রতি ১০ দিন অন্তর অন্তর কার্যকর হবে। তবে হাসপাতাল ও স্কুলগুলো এ পদক্ষেপের বাইরে থাকবে। কলম্বিয়ান সরকারের ঘোষণার পর- বৃহস্পতিবার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। বোগোটার মেয়র কার্লোস ফার্নান্দো গালান জানিয়েছেন, পানির এই সংকটে ‘ভয়ানক পরিস্থিতি’ দেখা দিয়েছে। বোগোটা শহর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্থানীয় জলাধারগুলোর পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে আসায় জরুরি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তীব্র গরম ও বৃষ্টির অভাবে কলম্বিয়ার জলাধারগুলোর পানি আশঙ্কাজনক হারে কমছে। বোগোটা শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণের সরবরাহ আসে সান রাফায়েল এবং চুজা জলাধার থেকে। সেটিতেও ধারণক্ষমতার ১৭ শতাংশের কম পানি রয়েছে। বোগোটার মেয়র কার্লোস ফার্নান্দো গালান জনসাধারণকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘এই সময়ে বোগোটায় আমরা এক ফোঁটা পানিও নষ্ট না করি। ফলে পানি নিয়ে যে বিধিনিষেধ চলছে, তা দ্রুত তুলে নেওয়া বা কমানো যাবে।’ মেয়র কার্লোস ফার্নান্দো গালানের ভাষ্যমতে, ‘গত ৪০ বছরের মধ্যে জলাধারটিতে এত কম পানি কখনোই ছিল না। সাধারণত বছরের এই সময় স্থানীয় জলাধারগুলোয় পানির পরিমাণ ২০ শতাংশেরও কম থাকে। কেবল ব্যতিক্রম দেখা গেছে চলতি বছরে। পানির স্তর ভয়াবহ পরিমাণ নিচে নেমে এসেছে। যা শহরবাসীর জন্য মোটেও সুখকর বিষয় নয়।’ কলম্বিয়ায় পানির সংকট নিয়ে এক্সে পোস্ট করে দেশটির প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো বলেছেন, ‘আগামী ৩০ বছর কলম্বিয়ার পানিসম্পদ রক্ষায় ‘উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন’ আনা হবে।’ বোগোটার বাসিন্দারাও পানির ব্যবহার কমিয়েছেন। শহরটির বাসিন্দা ক্লারা একসোবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘(পানির সংকটের কারণে) কিছু কাজ আর করা হচ্ছে না। যেমন- গাড়ি ধোয়া।’ শহরের আরেকজন বাসিন্দা আইজ্যাক সান্দোভাল বলেছেন, ‘গোসল করতে আমি সর্বোচ্চ চার মিনিট সময় নিচ্ছি। তবে এখন আর কাপড় ধোয়া হচ্ছে না।’ কলম্বিয়ার ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাম্প্রতিককালে পানির ভয়াবহ সংকটের কারণে প্রথমবারের মতো বোগোটা কর্তৃপক্ষ রাজধানীবাসীর জন্য পানিবণ্টন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে বাধ্য হয়। জাভেরিয়ানা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আরমান্দো সারমিয়েন্টো বলেছেন, ‘পৃথিবীর বেশির ভাগ শহর তাদের পানির জন্য জলাশয়ের ওপর নির্ভর করে। বোগোটা সে ক্ষেত্রে আলাদা, তারা জলাশয় থেকে বৃষ্টির ওপর বেশি নির্ভরশীল। তিনি আরও বলেছেন, বৃষ্টির ওপর নির্ভরতাই রাজধানী বোগোটাকে খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিয়েছে।’

লাতিন আমেরিকার দেশে পানির সংকট কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৬০০ মিটার (৮ হাজার ৫০০ ফুট) ওপরে অবস্থিত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রাজধানী শহরগুলোর একটি। পূর্বে আন্দিজ পর্বতমালা, পশ্চিমে ম্যাগডালেনা উপত্যকা রয়েছে। উপত্যকাটি বরাবরই পাহাড়ে উঠে গেছে। ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট অঞ্চল হওয়ায় প্রায়শই এই অঞ্চলে বৃষ্টির দেখা মেলে। ফলে বোগোটার প্রত্যেক নাগরিক জানেন, শহরে বৃষ্টি খুবই সাধারণ ব্যাপার। এই বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করেই শহরবাসীকে বেঁচে থাকতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তন এসব অঞ্চলে খরার প্রধান কারণ। এ ছাড়া দ্রুত নগরায়ণ ও দুর্বল অবকাঠামোকেও পরিবেশগত এ দুর্যোগের জন্য দায়ী করা হচ্ছে।

 

সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বে যেসব রাষ্ট্র

পানির অপর নাম জীবন। শুধু জীবন কেন, মানবসভ্যতাও গড়ে উঠেছে এই পানিসম্পদকে ঘিরেই। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, অতীতে কূপের আশপাশে গড়ে উঠেছিল বাজার কিংবা নগরী। আমরা জানি, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি। কিন্তু পৃথিবীর যত পানি আছে, তার প্রায় ৯৭.৫ শতাংশ পানের অযোগ্য বা চাষের অযোগ্য। অর্থাৎ লোনা পানি। আর মিঠা পানির পরিমাণ মাত্র আড়াই শতাংশ। তন্মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মিঠা পানি বরফ আকারে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে। আর বাকি তিন-চতুর্থাংশ ভূগস্থ পানি। আমরা মাত্র ০.৩ শতাংশ পেয়ে থাকি নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর এবং জলাশয় থেকে। অর্থাৎ পৃথিবীর মোট পানির এক ভাগেরও কম পানি পানযোগ্য। এই গোলার্ধের এত পানির প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করা সত্ত্বেও পানির সংকট বা অভাব দেখা দিচ্ছে। দিন দিন এই পানি ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত হচ্ছে। 

 

বিশ্বব্যাপী, ১৯৬০ সাল থেকে পানির চাহিদা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। জনসংখ্যা, কৃষিকাজ, শিল্প-জ্বালানিসহ মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে পানির ব্যবহারের ওপর। ফলে কোনো দেশের পানির সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে ব্যবধান যত বেশি হবে, সে দেশের পানির সংকট তত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। একদিকে পৃথিবীর মিঠা পানির উৎস কমে আসছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পানির চাহিদা বেড়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরে পৃথিবীর অর্ধেক (দুই-তৃতীয়াংশ) মানুষ তীব্র পানি সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে পানির সংকটকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শরণার্থী সংকট এবং সাইবার আক্রমণের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব পানি উন্নয়ন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আজকের বিশ্বের ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং পরিকল্পনায় পরিবর্তন না এলে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৫৭০ কোটি মানুষ পানির সংকটে পড়তে পারে।

সাম্প্রতিককালে ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের (ডব্লিউআরআই) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ চরম পানি সংকটের মধ্যে রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী এখন যে সংখ্যক মানুষ পানির সংকটে রয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এর সঙ্গে আরও ১০০ কোটি মানুষ যুক্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই দেশগুলো  অত্যন্ত পানির অভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। যার অর্থ তারা কৃষিকাজ, পশুপালন, শিল্প-জ্বালানির প্রয়োজনে তাদের পরিশোধিত পানি সরবরাহের ৮০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করে থাকে। এমনকি খরা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ পানির সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়।  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের মানুষ বেশি পানির সংকটে রয়েছেন। যেখানে মোট জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশের বেশি অত্যন্ত উচ্চ পানির অভাবে রয়েছে। একইভাবে অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার ৭৪ শতাংশের বেশি মানুষ পানির সংকটে পড়তে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় থাকা পাঁচটি দেশ হলো বাহরাইন, সাইপ্রাস, কুয়েত, লেবানন ও ওমান। বলা হচ্ছে, স্বল্প সময়ের জন্য খরা দেখা দিলেও এই দেশগুলোতে ব্যবহার্য পানি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এই পাঁচটি দেশের বাইরে যে পাঁচটি ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো হলো সৌদি আরব, চিলি, স্যান ম্যারিনো, বেলজিয়াম ও গ্রিস। গবেষণা প্রতিবেদনে পানির চরম সংকটে থাকা মানুষ বলতে বোঝায়, মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ পানি আসে পরিশোধিত উৎস থেকে। অর্থাৎ ব্যবহৃত পানি আবারও ব্যবহার উপযোগী করে তারা কাজে লাগায়। ডব্লিউআরআইয়ের পানি কর্মসূচির প্রধান সামান্থা কুজমা বলেন, ‘আমি ১০ বছর ধরেই পানি নিয়ে গভীরভাবে কাজ করছি। তবে হতাশার বিষয় হলো- এর কোনো পরিবর্তন হয়নি।’

আকাশ ছুঁয়েছে পানির দাম

[ লেবানন ]

ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে গত গ্রীষ্মে লেবাননের মোট জনসংখ্যার ৭১ শতাংশের বেশি পানি সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে চলমান খরা, লেবাননের অর্থনৈতিক সংকট এবং দুর্বল জল-ব্যবস্থাপনা পানির সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশটির পানির বাজারমূল্য এখন আকাশচুম্বী। ২০১৯ সালে ১ হাজার লেবানিজ পাউন্ড খরচে এক গ্যালন বোতলজাত পানি পাওয়া যেত। আজ সেই পানির দাম ৮ হাজার পাউন্ডের কাছাকাছি। লেবাননের রাজধানী বৈরুতসহ সারা দেশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের মতে, জলাবদ্ধতায় কাতার এবং ইসরায়েলের পর লেবানন বিশ্বের তৃতীয়-সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র। ফলে দেশটির পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি পরিষেবায় বিশেষ প্রভাব পড়েছে।

৩৫ বছর ধরে পানির সংকট

[ পাকিস্তান ]

পাকিস্তানে পানি একটি চলমান সমস্যা, বিশেষ করে ৩৫ বছর ধরে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে পাকিস্তানকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক পানির সংকটপূর্ণ দেশ হিসেবে স্থান দিয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি এবং পাকিস্তান কাউন্সিল অব রিসার্চ ইন ওয়াটার রিসোর্সেসও সতর্ক করে জানিয়েছে, দেশটি ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ পানির ঘাটতির মুখোমুখি হতে পারে। করাচিতেই ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবে পড়েছে। ইসলামাবাদের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নাঈম সালিক বলেছেন, ‘১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের সময়, বনভূমি ছিল প্রায় ৫ শতাংশ, যা এখন মাত্র ২ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। খরায় পড়েছে দেশটি। দেখা দিয়েছে পানির অভাব।’

পানি এখানে আরও দুষ্প্রাপ্য

[ আফগানিস্তান ]

রাজনৈতিক উত্থান ও পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানের সার্বিক অবস্থাই আজ সংকটাপন্ন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পানির সংকটও প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা সামরিক সংঘাত, অস্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আফগানিস্তানের আবহাওয়া পরিস্থিতিতে ঋণাত্মক প্রভাব রেখেছে। গত ৩০ বছরে আফগানিস্তানে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে প্রাকৃতিক খরা। আর সে কারণেই দেশটিতে সুপেয় খাবার পানির সংকট সবচেয়ে বেশি। ইউনিসেফের তথ্যমতে, আফগানিস্তানে  প্রতি ১০ জনের মধ্যে আটজন আফগান অনিরাপদ পানি পান করে। সেই সঙ্গে আজকের দিনে সেখানকার প্রায় ৯৩ শতাংশ শিশু উচ্চ পানির ঘাটতি এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছে।

সংঘাতে বিপর্যস্ত আবহাওয়া

[ সিরিয়া ]

২০২১ সালের শেষে ইউফ্রেটিস নদীর পানি নিম্নস্তরে নেমে আসে। ফলে বিগত ৭০ বছরের ইতিহাসে উত্তর সিরিয়া খরা পরিস্থিতিতে পড়েছে। এর বাইরেও এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ দেশটির আবহাওয়াকে আরও বেশি খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। ২০১০ সালের আগে রেডক্রসের ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সিরিয়ার শহরের ৯৮ শতাংশ মানুষ এবং গ্রামীণ সম্প্রদায়ের ৯২ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পেত। সেই সংখ্যাটা এখন ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ভয়ংকর তথ্য হলো- ৫০ শতাংশেরও কম মানুষ স্যানিটেশনের জন্য পরিষ্কার পানি পাচ্ছে। চলমান সংঘাত আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে সিরিয়ার ৬০ লাখের বেশি মানুষ বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যবিধি ও স্যানিটেশন পরিষেবা পাচ্ছে।

পানি ৫০ বছরের বড় সমস্যা

[ তুরস্ক ]

গত ২০ বছরের মধ্যে তুরস্কে ২০২১ সালে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এ ছাড়া এক গবেষণায় দেখা গেছে, তুরস্কে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে তুরস্কে অদূর ভবিষ্যতে তীব্র পানির সংকট দেখা দিতে পারে। তুরস্কে  মাথাপিছু পানির চাহিদা ৫১৯ কিউবিক মিটার। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে দেশটির জনসংখ্যা ১০ কোটিতে পৌঁছবে। তখন মাথাপিছু পানির চাহিদায় ঘাটতি পড়বে ১২০ কিউবিক মিটার। এই তথ্যগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, তুরস্ক অদূর ভবিষ্যতে একটি পানি সংকটময় দেশে রূপ নিতে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচার তুরস্কের মতে, দেশটির বুর্সা, মেরসিন, কোনিয়া, আদানা এবং আনাতোলিয়া পানি সংকটের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বলা হচ্ছে, গত ৫০ বছরে তুরস্কের অর্ধেক জলাভূমিতে পানির পরিমাণ কমেছে।

 

প্রায় বছরই কাটে বৃষ্টিহীন

[ বুরকিনা ফাসো ]

আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোতে নিরাপদ পানির ভয়ংকর সংকট রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বুরকিনা ফাসোর সমস্ত রোগের প্রায় ৮০ শতাংশ অনিরাপদ পানির কারণে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে বুরকিনা ফাসোতে। দেশটিতে প্রায় বছরই কেটে যাচ্ছে বৃষ্টিবিহীন। সাধারণত অক্টোবর থেকে মে পর্যন্ত দেশটিতে শুষ্ক মৌসুম চলে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুষ্ক মৌসুমের মেয়াদ আরও বেড়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত দেশটির উত্তরে সাহারা মরুভূমির সীমানা রয়েছে। ফলে দেশটিতে বছরের বেশি সময় কাটে বৃষ্টি ছাড়াই। মূলত মরুভূমিপ্রবণ এলাকা হওয়ার কারণে বুরকিনা ফাসোতে পানির অভাব প্রকট হয়ে উঠছে। আর অনিরাপদ পানি পানের কারণে দেশে অধিকাংশ রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে।

দুষ্পাপ্য যেন সুপেয় পানি

[ নাইজার ]

বিশুদ্ধ পানির ভয়াবহ সংকটে থাকা দেশগুলোর মধ্যে শুরুর দিকেই পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজার। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যেও এটি একটি। নাইজারের বেশির ভাগ লোকই কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই পর্যাপ্ত ও নিরাপদ পানির অভাবে চরম সংকটে দেশটি। ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফের হিসাবে নাইজারে ৫৪ শতাংশ নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে সুপেয় পানির অভাব ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। পৃথিবীতে যত মানুষ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, তার চেয়ে বেশি প্রাণ হারায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে। নাইজারে এমন অসংখ্য মানুষ রয়েছে যাদের প্রতিদিন ৩০ মিনিটের বেশি হেঁটে গিয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হয়। দেশটির প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি পানি সংকটের মুখে রয়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা।

 

পানির অভাব সর্বোচ্চ পর্যায়ে

[ নেপাল ]

নেপালের পানি সংকট নিয়ে শঙ্কিত পানিবিজ্ঞানীরা। অদূর ভবিষ্যতে এ সংকটের কারণে দেশটির শহরবাসীকে ভুগতে হবে। নেপালে প্রচুর বৃষ্টি হলেও গত ২০ বছরের পানি সংকটের চিত্র উদ্বেগজনক। দেশটির সুপেয় পানির একাধিক উৎস থাকলে অবকাঠামো উন্নত না হওয়ায় চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। কয়েকটির উপাত্ত বলছে, কাঠমান্ডু তার স্থানীয় পানির চাহিদার ২০ শতাংশের কম পূরণ করেছে। এ ছাড়া পানিদূষণ বেড়েছে ভয়াবহ আকারে। শুধু কাঠমান্ডুর কথা বলতে গেলেও দেখা যাবে শহরটির ভিতর দিয়ে যাওয়া আটটি নদীর মধ্যে একটিরও পানি পরিষ্কার নয়। দেশটিতে প্রায় ৬ হাজার নদী রয়েছে। কিন্তু দ্রুত নগরায়ণের ফলে  পানির অভাব প্রকট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরবাসী ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হওয়ায় পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।

 

তালিকায় থাকা আরও ঝুঁকিপূর্ণ দেশ

ন্যাশনাল ওয়াটার স্ট্রেস র‌্যাংকিং

অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ (৮০ শতাংশের বেশি)

বাহরাইন, সাইপ্রাস, কুয়েত, লেবানন, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরায়েল, মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বতসোয়ানা, ইরাক, ইরান, জর্ডান, চিলি, স্যান ম্যারিনো, বেলজিয়াম, গ্রিস, তিউনিশিয়া, নামিবিয়া, ভারত, সিরিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা।

উচ্চ ঝুঁকির দেশ (৪০-৮০ শতাংশ)

মেক্সিকো, মরক্কো, ইরিত্রিয়া, স্পেন, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, পেরু, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, থাইল্যান্ড, অ্যান্ডোরা, আলবেনিয়া, নাইজার, আফগানিস্তান, কিরগিজস্তান, পর্তুগাল, নেপাল, জিবুতি, মঙ্গোলিয়া এবং মেসিডোনিয়া।

মাঝারি-উচ্চ ঝুঁকির দেশ (২০-৪০ শতাংশ)

আর্মেনিয়া, লেসোথো, লুক্সেমবার্গ, অস্ট্রেলিয়া, চীন, মৌরিতানিয়া, গায়ানা, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কাজাখস্তান, আজারবাইজান, দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, সেনেগাল, জিম্বাবুয়ে,  লিথুয়ানিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, জার্মানি এবং ফিলিপাইন।

নিম্ন-মাঝারি ঝুঁকির দেশ (১০-২০ শতাংশ)

জাপান, এল সালভেদর, ফ্রান্স, তানজানিয়া, কম্বোডিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, হাইতি, ভেনিজুয়েলা, তিমুর-লেস্তে, সোমালিয়া, সুরিনাম, কুকবারিনা, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, সুদান, বুলগেরিয়া, ডোমেনিকান প্রজাতন্ত্র, নেদারল্যান্ডস, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য, মালদোভা, সার্বিয়া, কানাডা, এস্তোনিয়া, রোমানিয়া, রাশিয়া, অ্যাঙ্গোলা, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া এবং গুয়াতেমালা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর