সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

দাবদাহের রেকর্ড দেশে দেশে

আবদুল কাদের

দাবদাহের রেকর্ড দেশে দেশে

২০২৩ সালে বিশ্ববাসী সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে উষ্ণতম দিনের দেখা পেয়েছিল। ইউনাইটেড স্টেটস ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্রেডিকশনের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে ৩ জুলাই বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১৭.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল, যা ২০১৬ সালের আগস্টের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, ৩ জুলাইয়ের আগের বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১৬.৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, ২০২৪ সালটি হবে উষ্ণতার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার বছর। কারণ- এ বছর বিশ্ববাসী ‘এল নিনো’র দেখা যাবে।

ভাবছেন ‘এল নিনো’ আবার কী? বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, ‘এল নিনো’ হলো- আলাদা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েক বছর পর পরই বিশ্ববাসী ‘এল নিনো’র দেখা যায়। এ প্রাকৃতিক ঘটনার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। ফলে বৈশ্বকভাবে বাড়তে থাকে তাপমাত্রা। প্রচণ্ড গরমে মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যায়। সম্প্রতি  রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মাঝারি থেকে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে। তীব্র তাপের ঢেউ এখনো ইউরোপ, আমেরিকায় ধাক্কা না দিলেও এশিয়ার একটি বড় অংশকে গ্রাস করে ফেলেছে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসটি ছিল রেকর্ডের দিক থেকে তৃতীয়-উষ্ণতম দিন, যখন সারা বিশ্বের গড় তাপমাত্রা একই মাসে (১৯৯১-২০২০ পর্যন্ত) ০.৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। যদিও পৃথিবীর ইতিহাসে এসবের বাইরেও অসংখ্য উষ্ণতার রেকর্ড রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেথ ভ্যালি খ্যাত ফার্নেস ক্রিক অঞ্চলে। ১৯১৩ সালের ১০ জুলাই ডেথ ভ্যালিতে ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এরপর ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই তিউনেসিয়ার কেবিলি নগরীতে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। ২০১৭ সালের ২৯ জুন ইরানের আহভাজ নগরীতে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৯৪২ সালের ২১ জুন ইসরায়েলের তিরাত তসভি নগরীতে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৬ সালের ২১ জুলাই কুয়েতের মিত্রিবাহ শহরে ৫৩.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৬ সালের ২২ জুলাই ইরাকে বসরা নগরীতে ৫৩.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল।

আর হ্যাঁ, পরবর্তী রেকর্ডগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৮ মে পাকিস্তানের তুবরাত নগরীতে ৫৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২২ সালের জুলাই মাসে আরব আমিরাতে ৫২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৯৯৫ সালের ২৮ জুলাই মেক্সিকোর মেক্সিক্যালি শহরে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০১০ সালের ২২ জুন সৌদি আরবের জেদ্দা নগরীতে সাম্প্রতিককালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।

 

ফার্নেস ক্রিক [ আমেরিকা ]

৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস

পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্নেস ক্রিক। যা বিশ্ববাসীর কাছে ডেথ ভ্যালি বা মৃত্যু উপত্যকা হিসেবে পরিচিত। যেখানে ১৯১৩ সালের ১০ জুলাই ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৩৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সাধারণত গ্রীষ্মের মাসগুলোয় ডেথ ভ্যালির গড় তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। তবে তা কেবলই বাতাসের তাপমাত্রা। ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছিল এর থেকেও অনেক বেশি। ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই ডেথ ভ্যালির মাটির তাপমাত্রা ৯৩.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। যা প্রায় ফুটন্ত পানির তাপমাত্রার কাছাকাছি। বছরের পর বছর- এ অঞ্চলের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ঠিকই, তবে তা যাচাই করা হয়নি। ১৯২২ সালে ডেথ ভ্যালির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সেবার তাপমাত্রা ছিল ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

 

আহভাজ [ ইরান ]

৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস

ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমের নগরী আহভাজ, যা খুজেস্তান প্রদেশের রাজধানী হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। আচেমেনিড যুগের এ নগরীতে প্রায় ১৩ লাখ লোকের বসবাস। এ শহরের বুক চিড়েই প্রবাহমান কারুন নদ। শহরটি তার নয়টি সেতুর জন্য বিখ্যাত, বিশেষ করে ব্ল্যাক ব্রিজ এবং হোয়াইট ব্রিজ। ২০১৭ সালের ২৯ জুন ইরানের এ শহরে স্থানীয় সময় ৪.৫১ মিনিট থেকে ৫টা পর্যন্ত তাপমাত্রা ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) ভাষ্যমতে, এটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উষ্ণ তাপমাত্রার কাছাকাছি একটি রেকর্ড। তবে এর আগে বিশ্ববাসী ইরানের জনবসতিহীন এবং গ্রহের অন্যতম উষ্ণতম স্থানের সন্ধান পেয়েছিল। দেশটির দাশত-ই-লুত মরুভূমিতে ২০০৫ সালে ৭০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

 

মিত্রিবাহ [ কুয়েত ]

৫৩.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) রেকর্ডকৃত এবং যাচাইকৃত পঞ্চম সর্বোচ্চ তাপমাত্রার দেখা মেলে কুয়েতের মিত্রিবাহ নগরীতে। ২০১৬ সালের ২১ জুলাই মিত্রিবাহের আবহাওয়া অফিস অঞ্চলটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫৩.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১২৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পরিমাপ করে। যা ছিল ৭৬ বছরের মধ্যে কুয়েত সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত (তৎকালীন) সবচেয়ে উষ্ণতম তাপমাত্রা। ফলে অনেকটা দৃঢ়ভাবেই বলা যায়, কুয়েতের মিত্রিবাহ শহর এ যাবৎকালে এশিয়ার সর্বোচ্চ উষ্ণতম স্থান। বিশ্ববাসী এর আগের রেকর্ডের দেখাও পেয়েছিল কুয়েতের আল জাহরাহ নগরীতে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে- আল জাহরায় ৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড পরিমাপ করা হয়। যা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের উষ্ণতম স্থানই নয়, সমগ্র বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং উষ্ণতম স্থানের রেকর্ড।

 

বসরা [ ইরাক ]

৫৩.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস

মধ্যপ্রাচ্য হলো পৃথিবীর উষ্ণতম অংশ। যেখানে অতীতের অসংখ্য রেকর্ড ভেঙে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। ইরাকের বসরা নগরী তেমনি এক উষ্ণতম স্থান। যেখানে টানা দুই দিন উচ্চ তাপমাত্রা দেখা গেছে। ২০১৬ সালের ২১ জুলাই এ শহরের তাপমাত্রা ছিল ৫৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরের দিন ২২ জুলাই তাপমাত্রার পারদ উঠেছিল ৫৩.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাত্র একদিন আগে কুয়েতের মিত্রিবাহ শহরে একই পরিমাপের তাপমাত্রা দেখা গিয়েছিল। অবিশ্বাস্য হলেও- ইরাকের বসরা নগরী একই বছর তাপমাত্রার রেকর্ডে পৃথিবীর উষ্ণতম স্থানের রেকর্ড অর্জন করেছে। পারস্য উপসাগরের প্রায় ৭৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমের নগরী বসরা। যা আরব উপদ্বীপের মধ্যে শাট আল-আরব নদের তীরে অবস্থিত। আরব্য উপদ্বীপের এ শহর ১৫ লাখ মানুষের আবাসস্থল।

 

কেবিলি [ তিউনেসিয়া ]

৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস

আফ্রিকায় রেকর্ডকৃত সবচেয়ে উষ্ণতম তাপমাত্রার দেখা মেলে তিউনেসিয়ার কেবিলি নগরীতে। যা তিউনেসিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত নগরী। এটি নেফজাউয়া অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শহর। এটি মূলত দেশটির বৃহত্তম সাহারান লবণাক্ত হ্রদের আবাসস্থল। যা চোট এল জেরিদ নামে পরিচিত। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই তিউনেসিয়ার কেবিলি শহরে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড মাপা হয়েছিল। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উষ্ণ তাপমাত্রার রেকর্ড। আফ্রিকার তিউনেসিয়ার উষ্ণতার রেকর্ড ছাড়াও, পৃথিবীর প্রাচীনতম আবাসস্থল হিসেবেও পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রায় ২ লাখ বছর আগে- প্যালিওথিক যুগে তিউনেসিয়ায় মানুষের বসবাস ছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা কেবিলি শহরের পাশেই প্রাচীন যুগের অসংখ্য পাথরের অস্ত্র কিংবা হাতিয়ারের সন্ধান পেয়েছিলেন।

 

তিরাত তসভি [ ইসরায়েল ]

৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস

মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি উষ্ণতম শহর ইসরায়েলের তিরাত তসভি। এটি ইসরায়েল-জর্ডান সীমান্তের কাছে অবস্থিত। জর্ডান নদীর ঠিক পশ্চিমের ছোট্ট একটি শহর তিরাত তসভি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭২২ ফুট (২২০ মিটার) নিচে এর অবস্থান। এমন জলবায়ু সত্ত্বেও, শহরটিতে ১৮ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। ২০২১ সালের জনশুমারি অনুসারে, এখানে মাত্র ৯৭৫ লোকের বসবাস। ১৯৪২ সালের ২১ জুন ইসরায়েলের তিরাত তসভিতে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পরিমাপ করা হয়েছিল। ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ডের আবহাওয়াবিদ জেফ মাস্টারস বলেছেন, পরিমাপটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) ইসরায়েলকে ইউরোপের দেশ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। তাই দেশটিকে কোথায় রেখেছেন- তার ওপর নির্ভর করবে মহাদেশটির উষ্ণ স্থান বা শহরের রেকর্ড।

সর্বশেষ খবর