বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

যে কারণে গরম হচ্ছে পৃথিবী

আবদুল কাদের

যে কারণে গরম হচ্ছে পৃথিবী

নিকট অতীত থেকে দেখা যায়, ২০২৩ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের ‘উষ্ণতম বছর’। এমনটাই বলছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগরীয় ও বায়ুমন্ডলীয় প্রশাসন (এনওএএ), মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাসহ পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সংস্থা। গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রায় ২০২৩-কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে ২০২৪। এ ধারণা যে অমূলক নয়, তা বছরের প্রথম দিকে অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই খানিকটা আঁচ পাওয়া গেছে।  কিন্তু হঠাৎ পৃথিবীর উত্তাপ কেন ঊর্ধ্বমুখী হলো? বিজ্ঞানীরা কী বলছেন। কী কী কারণে দিন দিন বেড়ে চলেছে পৃথিবীর উত্তাপ, সেসব নিয়ে আজকের রকমারি...

 

►পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষের কার্যকলাপ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, হিমবাহ গলে যাওয়া এবং ঘন ঘন আবহাওয়ার নানা ঘটনাপ্রবাহগুলো এর সামগ্রিক প্রভাব...
► NASA এবং WMO (বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা)-এর গবেষণা অনুসারে পৃথিবীর তাপমাত্রা গত ১০০ বছরে প্রায় ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন...
 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আজকের বিশ্বে বেশ পরিলক্ষিত। এর কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। উত্তপ্ত হচ্ছে পৃথিবী। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, হিমবাহ গলে যাওয়া এবং ঘন ঘন আবহাওয়ার পরিবর্তন এর সামগ্রিক প্রভাব। কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া এর পরিণতি। এই প্রভাবগুলো পরিবেশ এবং মানব সমাজের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। স্মরণকালের গরমের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ২০২৩ সাল ছিল পৃথিবীর উষ্ণায়নের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বছর। কারণ সে বছর পৃথিবী দেখেছিল রেকর্ডকৃত উত্তপ্ত পৃথিবী। ইউনাইটেড স্টেটস ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্রেডিকশনের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৩ জুলাই বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১৭.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল, যা ২০১৬ সালের আগস্টের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, ৩ জুলাইয়ের আগের বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১৬.৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীরাও বলছেন, শিল্প যুগের প্রাক-মুহূর্ত থেকে আমাদের এই গ্রহ খুব দ্রুত উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ১৮৫০ সালের পর থেকে পৃথিবীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা গড়ে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়াও ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে গত চার দশকের প্রত্যেক দশকে তাপমাত্রা ক্রমাগতই বৃদ্ধি পেয়েছে।

আলোচনা এখন গরম নিয়ে। আরবের মরুর দেশের চেয়েও দেশের তাপমাত্রা কত বেশি, চলছে সেই তুলনা। অগ্নিবায়ুতে বিপর্যস্ত জনজীবন। সতর্কতা জারি করে আবহাওয়া অফিস, কখন বৃষ্টি হবে, সেই অপেক্ষায় আছে দেশের মানুষ...
গাছের কান্ড, বরফের স্তর, হ্রদের তলানিতে জমা পলি এবং প্রবাল- এসবই অতীতে জলবায়ু কেমন ছিল তার সাক্ষ্য বহন করছে। বর্তমানে যে হারে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এসব থেকে তার যথেষ্ট তথ্য প্রমাণাদিও পাওয়া যায়...

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত লাখ লাখ তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন। স্থলভূমিতে আবহাওয়া কেন্দ্র, সমুদ্রে জাহাজ এবং আকাশে স্যাটেলাইটের সাহায্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা মাপা বা নির্ণয় করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ২০৫০ সালের মধ্যে এ উষ্ণতা বৃদ্ধির হার যদি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে না পারি, তাহলে বিশ্বে এমন ওলটপালট শুরু হবে, যা আর সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। উষ্ণতা বৃদ্ধির হার বলতে বোঝানো হয়, ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের সময় বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা, যা ছিল তার তুলনায় এখন কতটা বেশি। ২০৫০ সালের মধ্যে যেন দেড় ডিগ্রির মধ্যে ধরে রাখা যায়, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সব দেশের বা সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। কয়লা, তেলসহ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে আমরা শিল্পপণ্য উৎপাদন করছি, বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি, আর অন্যদিকে ক্রমাগত বন উজাড় হচ্ছে। ফলে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। বাতাস কার্বন ডাইঅক্সাইড ধরে রাখে বলেই বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রাও বাড়ছে। এনওএর প্রধান বিজ্ঞানী সারা ক্যাপনিক মনে করেন, কার্বন নিঃসরণ একেবারে শূন্য না হওয়া পর্যন্ত গরম বাড়বে এবং প্রতিবছরই আগের রেকর্ড ভাঙবে।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার

দায়ী : ৮.২ শতাংশ

জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে, ঝুঁকির মুখে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ। জ্বালানি বৈশ্বিক নানা চাহিদা পূরণ করলেও এর ব্যবহার দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনকে উসকে দিচ্ছে। এই জীবাশ্ম জ্বালানি সামুদ্রিক জাহাজের জ্বালানি, যানবাহন এবং এভিয়েশন সংস্থাগুলোর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এরা সবাই মিলেই জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট অনুসারে, বৈশ্বিক জ্বালানির একটি বিরাট অংশ অর্থাৎ ৮.২ শতাংশ পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তুলছে। এর বাইরেও জ্বালানি হিসেবে বিশ্বব্যাপী গ্যাসের অধিক ব্যবহার শান্ত পৃথিবীকে অত্যধিক উত্তাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

অতিরিক্ত মৎস্য উত্তোলন

দায়ী : ২.৬ শতাংশ

অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণেও সামুদ্রিক বৈচিত্র্যের অভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এটি সমুদ্রের স্বাস্থ্যে ভীষণ প্রভাব বিস্তার করে। ২০২২ সালের ফ্রন্টিয়ার্স ইন মেরিন সায়েন্সের ইউরোপীয় জল-সমুদ্রের উষ্ণতা, অতিরিক্ত মৎস্য শিকার ও সমুদ্রের পানির দূষণ বিশ্লেষণ করে। পরে তারা এক প্রতিবেদনে বলে, অতিরিক্ত মৎস্য শিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। অতিরিক্ত মাছ ধরা সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ায়। কারণ এটি সামুদ্রিক প্রজাতির স্থিতিস্থাপকতাকে প্রভাবিত করে। কেননা যত বেশি মাছ এবং সামুদ্রিক জীবন আছে, তত বেশি কার্বন নির্গমন সঞ্চিত হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস করে।

বিদ্যুৎ এবং তাপ

দায়ী : ৩০.৬ শতাংশ

জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ এবং তাপ উৎপাদন প্রক্রিয়ার কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়লা, জীবাশ্ম তেল এবং গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক উৎস। এসব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে অনেক বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। ফলাফল বাতাসে বাড়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং নাইট্রাস অক্সাইডের আধিক্য। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, বিদ্যুৎ এবং তাপের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো হলো- ‘জলবায়ু পরিবর্তন’-এর প্রধান কারণ। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের মতে, বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই আজকের পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ওঠার জন্য দায়ী। পরিসংখ্যানগতভাবে বলতে গেলে, এই কার্যক্রমগুলো জলবায়ুর সবচেয়ে বড় শত্রু।

আলোচনায় ‘এল নিনো’

তীব্র গরম। সারা দেশ জ্বলছে। দাবদাহে বিপর্যস্ত নগরী। দিনের বেলা বের হলেই প্রচ- গরমের আঁচ লাগছে গায়ে। উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয় বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড আর অন্য কয়েকটি গ্যাস। প্রায় ১০০ বছর আগে বিজ্ঞানী স্যাভান্তে আরহেনিয়াস (১৮৫৯-১৯২৭) মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বহু প্রমাণ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে চলেছে দ্রুত। গ্যাসটি বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর বড় বিপদ ডেকে আনছে। অতএব সাবধান।’

 

টানা তিন বছর ‘লা নিনা’র দাপটের ২০২৩ সালে ‘এল নিনো’র আবির্ভাবের কথা নিশ্চিত করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা। ২০২৩ সালে আবহাওয়াবিদরা বারবার বলছিলেন, ‘এল নিনো’ আসছে। ফলে কমে যেতে পারে বৃষ্টির পরিমাণ, বাড়তে পারে গরম। সে বছর বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য ছিল, ২০২৪ সালটি হবে উষ্ণতার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার বছর। কারণ এ বছর বিশ্ববাসী ‘এল নিনো’র দেখা যাবে। এই এল নিনো আসলে কী? বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, ‘এল নিনো’ হলো আলাদা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েক বছর পর পরই বিশ্ববাসী ‘এল নিনো’র দেখা পায়। এ প্রাকৃতিক ঘটনার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়।

 

আসলে, এল নিনো মানে প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এই স্রোতের ফলে উষ্ণ হয়ে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল, বিশেষ করে পেরুর দিকের পানি। এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধের পুবালী বায়ুর প্রবাহ বদলে যায়। সাধারণত ৪ থেকে ৭ বছর পরপর এই পরিস্থিতি দেখা দেয়। স্থায়ী হয় ১২ থেকে ১৮ মাসের মতো। কিন্তু বর্তমানে এটি আরও ঘন ঘন দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে  বলেছেন যে, প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটি জলবায়ুর ধরন, যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য, সুপেয় পানি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে।

 

‘এল নিনো’র প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ পর্যন্ত- এসব অঞ্চলে দেখা দেয় বৃষ্টির অভাব। বেড়ে যায় তাপমাত্রা। শুকিয়ে যায় মাটি। এমনকি খরাও দেখা দিতে পারে।

 কৃষি এবং পশুপালন

দায়ী : ১১.১ শতাংশ

বিশ্বব্যাংকের মতে, কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম চালক। যা মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ১১.১ শতাংশ পর্যন্ত দায়ী। বিশেষজ্ঞদের মতে, মিথেন গ্যাস পরিবেশ দূষণে একটি বড় উদ্বেগের কারণ। কেননা এটি কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে ২৬ গুণ বেশি শক্তিশালী। গবাদি পশু পালন ও ধান উৎপাদন থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন নির্গত হয়। বিশ্বব্যাপী মিথেন নির্গমনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গবাদি পশু থেকে আসে। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, গরুর মাংস ভক্ষণ ছেড়ে দিতে পারলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন রোধে সাহায্য করবে। আর উৎপাদিত ধানও প্রচুর পরিমাণে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। বলা হচ্ছে- কৃষি খাত থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। যার পরিমাণ প্রায় ৭ শতাংশ।

শিল্পকারখানার কার্যক্রম

দায়ী : ৫.৮ শতাংশ

শিল্পবিপ্লব, বর্ধিত শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করার পেছনে অনেকাংশ দায়ী। এটি পৃথিবীর বায়ু, ভূমি ও পানির অত্যন্ত ক্ষতিসাধন করছে। কারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক ও জ্বালানি আশঙ্কাজনক হারে পানি ও বায়ুর দূষণ ঘটায়। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে উসকে দিচ্ছে। ফলে কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসের ওজন স্তরকে নষ্ট করে দিচ্ছে। যা মানুষ এবং প্রাণিকুলের পাশাপাশি পরিবেশেরও ক্ষতি করছে। কয়লা পোড়ানোর ফলে অ্যাসিড বৃষ্টি বেড়ে যায়। কারণ নির্গত ধোঁয়া আবহাওয়ায় মিশে বৃষ্টি হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, এই খাতের কারণে ৫.৮ শতাংশ কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হচ্ছে।

ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন

দায়ী : ৩.৪ শতাংশ

পৃথিবীর যত পানি তার প্রায় ৯৭.৫ শতাংশ পানের অযোগ্য। অর্থাৎ লোনা পানি। আর মিঠাপানির পরিমাণ মাত্র আড়াই শতাংশ। তন্মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ বরফ আকারে আর বাকি তিন-চতুর্থাংশ ভূগস্থ পানি। খাদ্য-পানি নিরাপত্তার জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বলা হচ্ছে, মানুষের পানযোগ্য পানির প্রায় ৪০ শতাংশ পূরণ করে থাকে ভূগর্ভস্থ পানি। তবে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন জলবায়ু পরিবর্তনে কম ভূমিকা পালন করলেও ধীরে ধীরে এর প্রভাব ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির ঘাটতি অল্প সময়ে পূরণ হওয়ার নয়। ফলে এটি আজকের পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন ৩.৪ শতাংশ দায়ী।

মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া

দায়ী : ২ শতাংশ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান লক্ষণ হলো পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর পরিস্থিতি। কেননা বরফ পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আজকের বিশ্বের সেখানে জমাটবাঁধা বরফ ক্রমেই গলে যাচ্ছে। বড় বড় বরফের চাঁই ধসে পড়ছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে, এ কারণে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ, বরফগলা পানি সাগর-মহাসাগরে মিশবে এবং এই বরফ গলা চলতে থাকলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমুদ্র উপকূলের অনেক এলাকা পানির নিচে চলে যেতে পারে। এর প্রভাবে শুধু যে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা-ই নয়, আরও অনেক ধরনের বিপদ আসবে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে ২ শতাংশ ভূমিকা পালন করছে।

বন ও বনাঞ্চল উজাড়

দায়ী : ৮ শতাংশ

কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ এবং অক্সিজেন তৈরির জন্য বন ও গাছ পৃথিবীর অপরিহার্য উপাদান। এই বনাঞ্চল আবার অগণিত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির আবাসস্থল। ওষুধ ও খাদ্য উৎপাদনের অন্যতম উৎস। এগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে ক্ষতিকর কার্বন বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। বন উজাড় হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। গাছ কাটা এবং ভয়াবহ দাবানলের কারণে বৈশ্বিকভাবে বন উজাড় হয়েছে। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, বন উজাড় করা বিশ্ব উষ্ণায়ন ও দূষণের ১০.৩ শতাংশ দায়ী। বনের ক্ষতি শুধু গ্রিনহাউস গ্যাসই নির্গত করে না, এটি জীববৈচিত্র্য, মাটির ক্ষয় এবং জলচক্রকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।

উৎপাদন এবং নগরায়ণ

দায়ী : ১৩.৩ শতাংশ

যানবাহনের তুলনায় উৎপাদন ও নির্মাণশিল্প প্রায়ই কম আলোচিত হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এসব শিল্পের ভূমিকাও কম নয়। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ১৩.৩ শতাংশ দায়ী উৎপাদন ও নির্মাণশিল্প। আধুনিক নগরায়ণের ফলে বিশ্বের অনেক শহর-নগর এলাকায় যানবাহন এবং শিল্পের ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি মানুষের খাদ্যপণ্য সামগ্রী উৎপাদনের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন গ্যাস এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক দ্রব্য পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ২০১৫ সালে এক সমীক্ষায় দেখা যায়, গৃহস্থালি পরিষেবা ও পণ্যগুলোর উৎপাদন-ব্যবহার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে ভূমিকা পালন করছে।

যানবাহনের বহুল ব্যবহার

দায়ী : ১৫ শতাংশ

ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের ২০১২ সালের তথ্য অনুসারে যানবাহন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু দূষণের প্রায় ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী। তন্মধ্যে ড্রাইভিং, ফ্লাইং ও অনুরূপ বাহনগুলো অন্যতম। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক- যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ। গবেষকদের ভাষ্য, আমেরিকায় পরিবহনের অতিরিক্ত ব্যবহার, দেশটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। অন্যদিকে আমেরিকার বিমানশিল্প (৯ শতাংশ) এবং সামুদ্রিক জাহাজশিল্প (৩ শতাংশ) গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। বিশ্ব আবহওয়া সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০৫০ সালের মধ্যে এসব শিল্পের কারণে জলবায়ু দূষণ এবং পরিবর্তন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর