বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিশ্বসেরা গোয়েন্দা চরিত্র

রণক ইকরাম

বিশ্বসেরা গোয়েন্দা চরিত্র

রহস্য-রোমাঞ্চের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। তাই বছরের পর বছর ধরে শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে রয়েছে রহস্যের বিস্তার। পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য রহস্যগল্প ও চরিত্রের আগমন ঘটেছে বইয়ের পাতায় কিংবা সেলুলয়েডের ফিতায়। কিন্তু তার মধ্যে খুব কম চরিত্রই ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছে। কখনো কখনো স্রষ্টার চেয়ে তার সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র বিখ্যাত হয়ে যায়। শার্লক হোমসের কথাই ধরা যাক। এই চরিত্রটি তার স্রষ্টা আর্থার কোনান ডায়েলের চেয়েও বেশি খ্যাতিমান। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তুঙ্গে থাকা চরিত্রগুলোর আরও কয়েকটি হচ্ছে জেমস বন্ড, ফেলুদা, এরকুল পিয়েরা, ব্যোমকেশ ইত্যাদি। আমাদের বাংলাদেশেও কাজী আনোয়ার হোসেনের তৈরি গোয়েন্দা চরিত্র মাসুদ রানা পেয়েছে আশাতীত জনপ্রিয়তা। এর বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের কথাসাহিত্যিক রেক্স স্টাউট সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র নিরো উলফ, জি কে চেস্টারটনের ফাদার ব্রাউন, মারভিল ডেভিশন পোস্টের চরিত্র আঙ্কল এবনার, রস ম্যাকডোনাল্ড-এর লিউ আর্চার, আর্ল ডের বিগারসের চার্লি চ্যানসহ আরও কতগুলো চরিত্র মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। বাস্তবে অস্তিত্ব নেই, তবু মানুষের মনের ভিতর অবস্থানকারী এসব দুর্ধর্ষ গোয়েন্দার গল্প নিয়েই আজকের আয়োজন।

 

জেমস বন্ড

তাকে মনে করা হয় বিশ্বের আধুনিকতম ও ভয়ংকর সিক্রেট এজেন্ট। নাম তার জেমস বন্ড-০০৭। নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অদ্ভুত গতিময়, প্রখর বুদ্ধি ও অসীম সাহসী এক মানুষের প্রতিচ্ছবি। জেমস বন্ড বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের লেখা উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্রবিশেষ। ১৯৫৩ সালে রচিত এ উপন্যাসে জেমস বন্ড রয়েল নেভি কমান্ডার হিসেবে রয়েছেন। সেটি ছিল ফ্লেমিংয়ের প্রথম উপন্যাস। তবে ফ্লেমিংয়ের পরবর্তী উপন্যাসে জেমস বন্ডকে নেভি কমান্ডার থেকে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের এক গোয়েন্দা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের নাম পরিবর্তন হয়। যেটি বর্তমানে এমআই ৬ নামে পরিচিত। এই চরিত্রটিকে নিয়ে এখন পর্যন্ত অসংখ্য চলচিত্র, উপন্যাস, কমিকস, ভিডিও গেমস তৈরি হয়েছে। মার্কিন পক্ষীবিদ জেমস বন্ড (জানুয়ারি ৪, ১৯০০- ফেব্রুয়ারি ১৪, ১৯৮৯)-এর নামানুসারে ১৯৫২ সালে জš§ নিল জেমস বন্ড সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’। তবে এটি বাজারে আসে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে।

এই গল্পের নায়ক জেমস বন্ড রয়্যাল নেভাল রিজার্ভের কমান্ডার, তার সাংকেতিক নম্বর-০০৭। এরপর ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক বছর একটা করে বই বেরিয়েছে। জেমস বন্ডকে নিয়ে মোট ১২টি উপন্যাস আর দুটি ছোটগল্পের সংকলন। ক্যাসিনো রয়্যাল লেখা শেষ হওয়ার পর প্রকাশক পাচ্ছিলেন না ফ্লেমিং। কিন্তু অনেক কষ্টে সেই বই বাজারে বের হতেই সবার ধারণা গেল পাল্টে। বাজারে বেরোতে না বেরোতেই তিন-তিনটি এডিশন! এর পরের চারটি বই ‘লিভ অ্যান্ড লেড ডাই’, ‘মুনরোকার’, ‘ডায়মন্ডস আর ফরএভার’ এবং ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’ এমন জনপ্রিয়তা পেল যে, কোনো সমালোচনা আর পাত্তাই পেল না। ইয়ান ফ্লেমিং তার রচিত উপন্যাসে জেমস বন্ডের কোনো বয়স উল্লেখ করেননি। তবে জেমস বন্ডকে নিয়ে নির্মিত বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রগুলোয় তাকে মোটামুটি ৪০-ঊর্ধ্ব এক মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে বন্ড একজন সাহসী, বুদ্ধিমান এবং চতুর পুরুষ। অন্যদিকে মেয়েদের কাছে জেমস বন্ড সব সময়ই যৌন আবেদনময়ী পুরুষ। বন্ড নিজেকে অন্য কারও সঙ্গে পরিচয় করেন, বন্ড জেমস বন্ড হিসেবে। মার্টিনি ককটেল হিসেবে ভদকাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বন্ড। তার সহজাত ও স্বাভাবিক পোশাক হচ্ছে একটি ডিনার জ্যাকেট। সচরাচর তিনি রোলেক্স সাবমেরিনার হাতঘড়ি পরতেই পছন্দ করেন। পরবর্তীতে তাকে ওমেগা সিমাস্টার ঘড়ি পরতেও দেখা যায়। অনেকেই জানেন না বন্ডের-০০৭ সাংকেতিক নম্বরটির মানে কী। আসলে এই নম্বরটি জেমস বন্ডের ধারণ করা নম্বর। যা তার প্রায় সব গল্পেই দেখানো হয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল একটি গল্প। ‘ইউ অনলি লাইভ টুয়াইস’। এ উপন্যাসে তাকে অস্থায়ীভাবে-৭৭৭৭ নম্বর দেওয়া হয়। এমআই-৬ এর প্রতিটি এজেন্টের একটি করে কোড নম্বর থাকে। আর এ নম্বরের আগে যাদের-০০ থাকে তারা কর্তব্যে-কর্মে প্রয়োজনে হত্যা করার ক্ষমতা রাখে। আর জেমস বন্ড চরিত্রের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং তার জীবদ্দশায় জেমস বন্ডের ওপর ১২টি বই লিখেছেন। তার মৃত্যুর পর অন্য লেখকরা এই সিরিজ লিখেছেন। এসব সিরিজে মোট ১৩ জন এজেন্ট আছে যারা-০০ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে সপ্তম এজেন্ট ছিলেন জেমস বন্ড। আর সে কারণেই তাকে জেমস বন্ড-০০৭ বলা হয়। বই অনুসারে বন্ডের জš§ ১১ নভেম্বর ১৯২১ সালে জার্মানিতে। তার বাবা অ্যান্ড্রু বন্ড এবং মাতা মনিক ডেলাক্রইক্স বন্ড। তার বাবা একজন স্কটিশ এবং মা সুইস। তবে বন্ডের জাতীয়তা ব্রিটিশ। বন্ড পেট বটম নামক গ্রামের বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১২ বছর বয়সে (ইয়াং বন্ডে ১৩ বছর) এটন কলেজে সংক্ষিপ্ত সময়ে অধ্যয়ন করেন। এটন থেকে বন্ড চলে যান এবং তার পিতার অধ্যয়নকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় ফেটেস কলেজে ভর্তি হন। দি অথরাইজড বায়োগ্রাফি এবং ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ উপন্যাসে তাকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ইউনিভার্সিটি অব জেনেভায় অধ্যয়ন করতে দেখা যায়। বন্ডের শিক্ষা সম্বন্ধে ফ্লেমিং এটন এবং ইউনিভার্সিটি অব জেনেভায় অধ্যয়নের কথা উল্লেখ করেন। বিশ্বজুড়ে জেমস বন্ডের এই জনপ্রিয়তার হাওয়া লাগে চলচ্চিত্রের বাজারেও। এখন পর্যন্ত ২৩টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে জেমস বন্ডকে নিয়ে। এ ছবিগুলো কেবল জেমস বন্ড-০০৭-কে নিয়েই নির্মিত হয়েছে। তবে গোল্ডেন আই চলচ্চিত্রে এজেন্ট-০০৭ এবং এজেন্ট-০০৬ দুজনকেই দেখানো হয়েছে।

 

শার্লক হোমস

গোয়েন্দা শার্লক হোমসের গল্প সবারই জানা। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দা মনে করা হয় স্যার আর্থার কোনান ডায়েলের সৃষ্ট গোয়েন্দা শার্লক হোমসকে। পৃথিবীর মানুষের সামনে শার্লক হোমস প্রথম আসেন ১৮৮৭ সালে। আর্থার কোনান ডায়েল ডাক্তারি পাস করে প্লাইমাউথের সাউথ সির ১ নম্বর বুশ ভিলাতে বাড়ি ভাড়া করে বসবাস শুরু করেন। মজার ব্যাপার হলো- তখনই ডাক্তারির পাশাপাশি তার মাথায় লেখালেখির ভূত চাপল। তাই ডাক্তারির পাশাপাশি লেখালেখির কাজে হাত দিলেন ডায়েল। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে লিখেও ফেললেন একটি উপন্যাস। ‘এ টেঙ্গলড স্কিন’ নামের উপন্যাসটির মাধ্যমেই গোয়েন্দা শার্লক হোমসের জš§। তবে আক্ষরিক অর্থে জš§ নয়। এই উপন্যাসের মাধ্যমে মানুষের সামনে প্রথম আবির্ভূত শার্লকের বয়স দেখানো হয় ৩৩ বছর। প্রথমে শার্লক হোমসের নাম ছিল ভিন্ন। প্রথমে ছিল শেরিনফোর্ড হোমস। পরে সেটা পছন্দ না হওয়ায় ডায়েল নিজেই চরিত্রটির নাম পাল্টে ফেলেন। শুধু তাই নয়, পাল্টে গেল উপন্যাসের নামও। এবার উপন্যাসের নাম দিলেন ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’। গোয়েন্দা শার্লক হোমস নিয়ে তিনি ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ বইটি যখন লেখেন তখন এটা ছাপানোর মতো প্রকাশক খুঁজে পাননি। অনেক চেষ্টা করে একটি ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন হোমসের অ্যাডভেঞ্চারের প্রথম বর্ণনা। এরপর শার্লক হোমসের জনপ্রিয়তা পাল্টে দেয় ডায়েলের জীবনের গতিপথ। কোনান ডায়েল হোমসকে নিয়ে চারটি উপন্যাস ও ৫৬টি ছোটগল্প লিখেছেন। প্রথম কাহিনি ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ ১৮৮৭ সালের বিটন’স ক্রিসমাস অ্যানাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কাহিনি ‘দ্য সাইন অব দ্য ফোর’ ১৮৯০ সালে লিপিনকোটস মাসিক ম্যাগাজিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮৯১ সালে দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রথম ছোটগল্পের সিরিজটি প্রকাশিত হওয়ার পরই শার্লক হোমস চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত হোমসকে নিয়ে একগুচ্ছ ছোটগল্পের সিরিজ এবং আরও দুটি ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়। হোমস কাহিনির পটভূমির সময়কাল ১৮৮০ থেকে ১৯০৭ সাল; শেষ ঘটনাটির সময়কাল অবশ্য ১৯১৪। চারটি বাদে সব কটি কাহিনিই হোমসের বন্ধু তথা জীবনীকার ডা. জন ওয়াটসনের জবানিতে লেখা। দুটি গল্প [দ্য ব্লাঞ্চেড সোলজার্স ও দ্য লায়ন’স মেন হোমসের নিজের জবানিতে এবং অন্য দুটি গল্প দ্য ম্যাজারিন স্টোন ও হিজ লাস্ট বো] তৃতীয় পুরুষে লেখা। দুটি গল্প আবার [দ্য মাসগ্রেভ রিচুয়াল ও দ্য গ্লোরিয়া স্কট] হোমস ওয়াটসনকে নিজের স্মৃতি থেকে শুনিয়েছেন এবং ওয়াটসন সেখানে কাহিনির কাঠামোটিই মাত্র বর্ণনা করেছেন। প্রথম উপন্যাস এ স্টাডি ইন স্কারলেটের মধ্যবর্তী অংশে হোমস ও ওয়াটসনের অজ্ঞাত ঘটনার দীর্ঘ বর্ণনা করা হয়েছে এক সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর জবানিতে। চোখের ডাক্তার হিসেবে খুব বেশি জনপ্রিয় না হলেও লেখক হিসেবে ডায়েল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং এক সময় তার লেখা চরিত্র শার্লক হোমস তার চেয়ে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। আর্থার কোনান ডায়েল যখন স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে রয়েল ইনফর্মায় কাজ করতেন তখন জোসেফ বেল নামে একজনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। জোসেফ বেলের গোয়েন্দাসুলভ মনোভাব তাকে লিখতে উৎসাহিত করে এবং তার মনের ভিতর থেকে শার্লক হোমসের জš§ হয়। সে হিসেবে গোয়েন্দা শার্লক হোমসের জš§ ১৮৫৪ সালের দিকে। হোমসের এক ভাই মাইক্রোসফট হোমস। দাদি ফরাসি শিল্পী ভারনেটেজ গেন। শার্লক হোমসের সঙ্গী হলেন ডাক্তার ওয়াটসন। যিনি শার্লক হোমসের গোয়েন্দা কাহিনিগুলো সবাইকে জানাতেন। এ ছাড়া রাস্তার একদল ছেলের সঙ্গে তার খুব ভাব ছিল। এদের নাম হোমস দিয়েছিলেন ‘দ্য বেকার স্ট্রিট ইরেগুলার্স।’

শার্লক হোমসের জ্ঞান ও বুদ্ধি দুরন্ত প্রখর। অবসর সময়ে তিনি ভায়োলিন বাজাতে পছন্দ করতেন। একজন বক্স এবং তলোয়ারবিদ হিসেবে তিনি যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তার অ্যাডভেঞ্চারের সময় সঙ্গী থাকত পিস্তল, পাইপ, ম্যাগনিফাই গ্লাস ও ডিয়ার স্ট্যাকাজ ক্যাপ। যে কোনো বিষয়ে ভয়শূন্য থাকা মানুষের মন বুঝে ফেলা এবং বন্ধুত্ব করা তার সহজাত গুণ। শার্লক হোমস সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন পুলিশকে। ওয়াটসনের বক্তব্য অনুসারে হোমসের গুরুত্বপূর্ণ ৫৩টি কেসের মধ্যে ৪৯টির ক্রেডিট নিয়েছে পুলিশ। এতে অবশ্য হোমস কিছুই মনে করেননি। শার্লক হোমস এক সময় সবার কাছে এত বেশি কাক্সিক্ষত হয়ে ওঠেন যে, লেখক আর্থার কোনান ডায়েল হাঁপিয়ে ওঠেন। ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ বইয়ে হোমসের মৃত্যু হলে পাঠকদের তীব্র প্রতিবাদে আবার তাকে ফিরিয়ে আনেন লেখক। মানুষের মনে এখনো শার্লক হোমস এক জীবন্ত চরিত্র হয়ে আছে। শার্লক হোমসের সিরিজ অনূদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। হোমসের ওপর নির্মিত হয়েছে ২০০-এরও বেশি ছবি। অন্তত ৭০ জন অভিনেতা শার্লক হোমস সেজেছেন এতে। মঞ্চে বা এর বাইরে এই সংখ্যা আরও বেশি।

 

মাসুদ রানা

বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কল্পিত দুর্ধর্ষ এক এজেন্ট। এই মাসুদ রানা মূলত জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় চরিত্র। ১৯৬৬ সালে ধ্বংস পাহাড় প্রচ্ছদ নামের প্রথম গ্রন্থটি থেকে শুরু করে সেবা প্রকাশনী থেকে মাসুদ রানা সিরিজে এই চরিত্রকে নিয়ে মোট বই বেরিয়েছে ৪০০-এরও বেশি।

১৯৬৬ সালের কথা। বাংলা রহস্য সাহিত্যে তখন কেবল ব্যোমকেশের জনপ্রিয়তা। ফেলুদা সবে প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যেই নতুন ধারার নতুন একটি গোয়েন্দা চরিত্রের জš§ হলো। এ গোয়েন্দার নাম মাসুদ রানা।

বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কল্পিত দুর্ধর্ষ এক এজেন্ট। এই মাসুদ রানা মূলত জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় চরিত্র। ১৯৬৬ সালে ধ্বংস পাহাড় প্রচ্ছদ নামের প্রথম গ্রন্থটি থেকে শুরু করে সেবা প্রকাশনী থেকে মাসুদ রানা সিরিজে এই চরিত্রকে নিয়ে মোট বই বেরিয়েছে চার শরও বেশি। সে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর এবং তার সাংকেতিক নাম এমআর নাইন। এ ছাড়া ‘রানা এজেন্সি’ নামক একটি গোয়েন্দা সংস্থাও পরিচালনা করেন রানা। মাসুদ রানার নামকরণ করা হয় দুজন বাস্তব মানুষের নামের অংশ মিলিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন তার স্ত্রী সংগীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরামর্শ করে নামটি নির্বাচন করেন। তাদের বন্ধু মাসুদ করিমের ‘মাসুদ’ আর কাজী আনোয়ার হোসেনের ছেলেবেলার হিরো মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিংহ থেকে ‘রানা’ নিয়ে নাম দাঁড়ায় মাসুদ রানা। রানার চেহারার ক্ষেত্রে লেখক চেয়েছিলেন পাঠকই নিজেকে রানার জায়গায় বসিয়ে ভাবুক। তাই তিনি রানার চেহারার কোনো স্পষ্ট বর্ণনা দেননি। মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম দুটি বই বাদে বাকিগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত। মাসুদ রানার চরিত্রটিকে মূলত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জেমস বন্ড চরিত্রটির বাঙালি সংস্করণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। মাসুদ রানার প্রথম বইটি কাজী আনোয়ার হোসেনের ১০ মাসের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল। তিনি ওই সময়ে মোটরসাইকেলে তার রাঙামাটি ভ্রমণের কথা স্মরণ করে লেখেন উপন্যাসটি। আর ওই কাহিনিই পাল্টে দেয় হিসাব-নিকাশ।

কারণ মাসুদ রানাই বাংলা সাহিত্যের প্রথম চরিত্র যা বাংলাদেশের চরিত্র হলেও একটি বৈশ্বিক চরিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মাসুদ রানার সহায়ক চরিত্রে প্রথমেই মেজর জেনারেল রাহাত খানের নাম। তিনি বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান। তারই তত্ত্বাবধানে রানা নিজের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এ ছাড়া তার কাজে সহায়তা করে থাকে সোহেল, সলিল, সোহানা, রূপা, গিলটি মিয়া প্রমুখ চরিত্র। সিরিজের সোহেল চরিত্রটি খানিকটা জেমস বন্ডের বন্ধু ফিলিক্স লেইটারের আদলে গড়া। সোহানা হচ্ছে লেখকের কল্পিত বাঙালি মেয়ে। মাসুদ রানার অধিকাংশ কাহিনিই বিভিন্ন বিদেশি লেখকের বই থেকে ধার করা।

অ্যালিস্টার ম্যাকলিন, রবার্ট লুডলাম, জেমস হেডলি চেজ, উইলবার স্মিথ, ক্লাইভ কাসলার, ফ্রেডরিক ফরসাইথসহ বহু বিদেশি, বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যিকের লেখা কাহিনি থেকে ধার করে মাসুদ রানার কাহিনি লেখা হয়। কখনো কোনো বই বিদেশি কোনো একক বই থেকেই অনুবাদ করা হয়। আবার কখনো একাধিক বই মিলিয়ে লেখা হয়। যেমন- সিরিজের তৃতীয় বই স্বর্ণমৃগ লেখা হয়েছিল ইয়ান ফ্লেমিংয়ের তিনটি কাহিনির সহায়তা নিয়ে।

 

ফেলুদা

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা গোয়েন্দা মনে করা হয় ফেলুদাকে। এই ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়। জনপ্রিয় এই কাল্পনিক চরিত্রটির আসল নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। তবে এই নাম ছাপিয়ে বছরের পর বছর ধরে বই-মঞ্চ আর সিনেমায় ফেলুদা নামেই এর রাজত্ব। এই চরিত্রটি প্রথম মানুষের সামনে আসে ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় পত্রিকা সন্দেশ-এর ডিসেম্বর সংখ্যায় সত্যজিৎ রায়ের লেখা ফেলুদা সিরিজের প্রথম গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ প্রকাশিত হয়। সেই শুরু। এরপর কেবল চরিত্রের জনপ্রিয়তা আর বিস্তৃতি বেড়েই চলেছে। কখনো কমেনি। অধিকাংশ ফেলুদা কাহিনি প্রথম পূজাবার্ষিকী দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। অল্প কিছু কাহিনি প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশ পত্রিকায়। বইগুলোর বাঁধাই কপি প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে।

এ ছাড়া ফেলুদার ওপরে কমিক স্ট্রিপও প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশ ফেলুদা বইয়ের প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ সত্যজিৎ রায়ের নিজের আঁকা। ফেলুদা সিরিজের সব গল্প ও উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ফেলুদা সিরিজের মোট ৩৫টি সম্পূর্ণ ও চারটি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ফেলুদার প্রধান সহকারী তার খুড়তুতো ভাই তোপসে রঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে ও লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি (ছদ্মনাম জটায়ু)। ফেলুদার দেওয়া তোপসে নামেই সে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এই চরিত্রটির সঙ্গে অনেকেই শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডায়েলের জন ওয়াটসনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন। জন ওয়াটসন যেমন শার্লক হোমসের সব সময়ের সঙ্গী তেমনি তোপসেও ফেলুদার সর্বক্ষণের সঙ্গী। ফেলুদার প্রায় সব অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সে লিখে রাখে। ফেলুদা তার কাকার পরিবার অর্থাৎ তোপসেদের সঙ্গেই ২১, রজনী সেন রোড, কলকাতা-৭০০০২৯-এর বাড়িতে থাকে। দক্ষিণ কলকাতায় রজনী সেন রোড থাকলেও ২১ নম্বর বাড়িটি অস্তিত্বহীন। ফেলুদার গল্পের আরেক চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলি বা লালমোহন বাবু ফেলুদার বন্ধু। তিনি একজন লেখক। জটায়ু ছদ্মনামে রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখেন। লালমোহন বাবু বাংলায় রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের একজন জনপ্রিয় লেখক এবং তার নিজের মতে সারা ভারতে তার অনুগামীরা ছড়িয়ে আছে।

 

ব্যোমকেশ

বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে মধুর গোয়েন্দা বলা হয় ব্যোমকেশ বক্সিকে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি এই গোয়েন্দা চরিত্রটি ভারতীয় উপমহাদেশের পাঠকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। শরদিন্দুর লেখার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে সহজ ও সাবলীলতা। ভাষায় সাধু, চলিতের পার্থক্য খোঁজার কোনো সুযোগ নেই। যেন নতুন কোনো ভাষারীতি প্রাঞ্জলতার রীতি মেনে লেখেন তিনি। সংক্ষিপ্ত এবং সহজ ভাষার কারণে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ গল্পগুলো খুব অল্প সময়ে পড়া হয়ে যায়। আর এসব কারণেই অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যোমকেশ সিরিজটি সবার কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যোমকেশ সিরিজের প্রথম গল্প ‘সত্যান্বেষী’। গোয়েন্দা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও নিজেকে কখনোই গোয়েন্দা ভাবেন না ব্যোমকেশ।

গোয়েন্দা কথাটায় তার এক প্রকারের অ্যালার্জি রয়েছে। তিনি নিজেকে বলেন সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যোমকেশ চরিত্র নিয়ে ৩৩টি কাহিনি লিখেছেন। এর মধ্যে ১টি অসম্পূর্ণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সত্যান্বেষী, পথের কাঁটা, সীমন্ত-হীরা, মাকড়সার রস, চোরাবালি, অগ্নিবাণ, উপসংহার, রক্তমুখী নীলা, ব্যোমকেশ ও বর’দা, চিত্রচোর, দুর্গরহস্য, চিড়িয়াখানা, রক্তের দাগ, মণিমন্ডন, অমৃতের মৃত্যু, শৈলরহস্য, অচিন পাখি ইত্যাদি। সত্যজিৎ রায় ব্যোমকেশ সিরিজের গল্প অবলম্বনে চিড়িয়াখানা নামে একটি সিনেমা তৈরি করেছিলেন। যাতে মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার।

সর্বশেষ খবর