শুক্রবার, ২৪ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের শাসকদের পরিণতি

আবদুল কাদের

ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের শাসকদের পরিণতি

আশির দশকের আগে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ভালো। যে আমেরিকা আজ ইরানকে লাগাতার নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেই আমেরিকা ইসলামী বিপ্লবের আগে ইরানের সুরক্ষায় খরচ করত কোটি কোটি টাকা। কিন্তু পরে সম্পর্কে ফাটল দেখা দিল। বন্ধুত্ব শত্রুতায় পরিণত হলো। আর এই শত্রুতার প্রধান কারণ ‘ইসলামী বিপ্লব’। শত্রুতার ফলে ইরানের শাসকরাও কালে কালে দেশ পরিচালনায় নানা বাধাবিপত্তিতে পড়েছিলেন। সেই শাসকদের পরিণতি নিয়ে এই আয়োজন...

 

► আক্ষরিক অর্থে ১৯৭৮ সালে শুরু হয় ‘ইসলামী বিপ্লব’।  সে সময় সরকারপন্থি একটি পত্রিকা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে ‘ব্রিটিশদের গুপ্তচর’ বলে অভিহিত করে। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ।

► ১৯৭৯ সালে দেশত্যাগ করেন ইরানের তৎকালীন রাজা মোহাম্মদ রেজা শাহ। তিনি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। একই সঙ্গে ইরানে বিলুপ্ত হয় আড়াই হাজার বছরের পুরনো পারস্য রাজতন্ত্র।

 

ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাম্রাজ্য- ‘পারস্য সাম্রাজ্য’। যা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো সভ্যতাগুলোর একটি। সেই সভ্যতা হলো- আজকের মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র ইরান। যা আজকের বিশ্বে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূরাজনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আবার এ দেশে শিয়া-সুন্নি মুসলমানদের জাতিগত দ্বন্দ্বও বেশ পুরনো। গেল বিংশ শতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দেয় ইরান। যেখানে হাজার বছরের পুরনো রাজতন্ত্র ‘ইসলামী শাসনে’ রূপ নেয়। আলোচিত এ ঘটনার মূলে রয়েছে ‘ইসলামী বিপ্লব’।

সময়টা আশির দশকের আগের, তৎকালীন আমেরিকা-ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। আমেরিকা সে সময় ইরানের সুরক্ষায় ব্যয় করত কোটি কোটি টাকা। আধুনিক সমরাস্ত্র থেকে এয়ারক্রাফট; সব ক্ষেত্রে আমেরিকাকে পাশে পেত ইরান। এমনকি আজ যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে যাচ্ছে লাগাতার নিষেধাজ্ঞা! সেই আমেরিকাই এক সময় পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রধান রসদ ‘ইউরেনিয়াম’ ইরানের হাতে তুলে দিয়েছিল। বিনিময়ে ইরানও আমেরিকাকে দিয়েছিল তেলের খনি। তৎকালীন ইরান তাদের দেশের ৪০ শতাংশ তেলের খনি আমেরিকার কোম্পানিকে ‘লিজ’ দিয়েছিল। এক কথায়, ইরান এবং আমেরিকার মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই বন্ধুত্ব শত্রুতায় পরিণত হলো। আর এই শত্রুতার প্রধাণ কারণ হলো- ইরানের ‘ইসলামী বিপ্লব’। ইরানে রাজার ক্ষমতা সরিয়ে শুরু হয় ‘ইসলামী শাসন’।

১৯৭৮-৮৯ সালে সংঘটিত হওয়া ঐতিহাসিক ‘ইসলামী বিপ্লব’ ইরানের আড়াই হাজার বছরের পুরনো পারস্য রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়। যার সাফল্য সুদূরপ্রসারী হলেও খালি চোখে দেখতে গেলে এর প্রাথমিক সাফল্য হলো- ‘পাহলভি রাজবংশ’-এর শাসন থেকে ইরানিদের বেরিয়ে আসা। তবে এই শাসনকাল মূলত দুজন রাজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রথমত, রাজা রেজা শাহ এবং দ্বিতীয়ত তার পুত্র রাজা মোহাম্মদ রেজা শাহ। এর আগে ইরান শাসন করত কাজার রাজবংশ, তার আগে সাফাভিদ রাজবংশ। তবে পাহলভি রাজবংশের হাত ধরে হাজার বছরের পারস্য সাম্রাজ্যের ইতি ঘটে।

১৯৭৯ সালে ‘ইসলামী বিপ্লবে’র বীজ বোনা হয়েছিল অনেক আগেই। ১৯০৬ সালে কাজার রাজবংশের বিরুদ্ধে ইরানিদের ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ থেকেই জমা হয়- ‘ভবিষ্যৎ বিপ্লব’। যদিও শেষ পর্যন্ত এই বিপ্লবটি একরকম ব্যর্থই হয়েছিল। এর প্রধান কারণ হচ্ছে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ওলামা সমাজ বিপ্লবের পক্ষ থেকে নিজেদের সমর্থন সরিয়ে নেয়। আর এই সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছিল ব্রিটিশরা। কারণ বিপ্লব সফল হলে ইরান শক্তিশালী হয়ে উঠত এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের প্রভাব কমে যেত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বে তেলের কদর বেড়ে যায়। আর মধ্যপ্রাচ্যে তেল আবিষ্কৃত হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর মাঝে প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে যায়। আর এই তেল কোম্পানি  চালাতে ব্রিটিশরা গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে ইরানে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। যারা সামরিক শাসক রেজা খানকে ইরানের ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করে। শর্ত- ইরানের খনি থেকে ব্রিটিশদের তেল উত্তোলন করতে দিতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই পদত্যাগ করেন রাজা রেজা শাহ। ক্ষমতায় বসেন তার ছেলে মোহাম্মদ রেজা শাহ। এ সময় ইরানে ব্রিটিশদের প্রভাব কিছুটা কমে আসে। ইরানের শাসনে জনমতের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তৎকালীন ইরানের কমিউনিস্ট ধারার রাজনৈতিক দল ‘টুডে পার্টি’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৫১ সালের নির্বাচনে এই দলের মোহাম্মদ মোসাদ্দেগ জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রিত্ব পান। তিনি ইরানের শাসনে কমিউনিজমের প্রয়াস চালান। যার প্রথম পদক্ষেপই ছিল তেলের খনিগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণ করা। কিন্তু তিনি বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ১৯৫৩ সালে শিয়া ওলামাদের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হন। যা মোহাম্মদ শাহের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৫ সালে তিনি দেশের প্রধান এবং বড় দুই রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে তাদের স্থলে ‘রিসার্জেন্স পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু হয় ইরানিদের খারাপ সময়। তিনি হয়ে ওঠেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। রাজনৈতিক নির্যাতন, গণমাধ্যমে কঠোর বিধিনিষেধ, ভিন্নমতের বিরুদ্ধাচরণ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক হত্যা ও গুম ইত্যাদির মাধ্যমে ইরানিদের মাঝে ত্রাসের রাজ্য কায়েম করেন। পাশাপাশি তেল সাম্রাজ্যের দুর্নীতি তো আছেই। মোহাম্মদ রেজা শাহ-এর ওপর থেকে সাধারণ ইরানিদের আস্থা উঠে যায়। অতি আধুনিকায়ন নষ্ট করতে থাকে ইরানের সংস্কৃতি। আর এসবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন শিয়া মুসলিমদের প্রভাবশালী ওলামা আয়াতুল্লাহ খামেনি। তবে আক্ষরিক অর্থে ১৯৭৮ সালের ৭ জানুয়ারি ‘ইসলামী বিপ্লব’ শুরু হয়ে যায়। সেদিন কোনো এক সরকারপন্থি পত্রিকা খামেনিকে ব্রিটিশদের গুপ্তচর বলে অভিহিত করে। আর তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে খামেনির কিছু সংখ্যক অনুসারী রাস্তায় নামে। উল্লেখ্য, খামেনি তখন দেশের বাইরে। প্রাথমিকভাবে ইরানিরা রাস্তায় না নামলেও জনমত পুরোপুরি শাহের বিপক্ষে। ধীরে ধীরে আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। রাস্তায় বাড়তে থাকে সাধারণ ইরানিদের উপস্থিতি। সরকারি নির্দেশনায় পুলিশের গুলিও কেড়ে নিতে থাকে সাধারণ ইরানিদের প্রাণ। আপামর জনগণের ক্ষোভও বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে রাস্তায় মিছিলের আয়তনও। মাত্র এক বছরের মাথায়, ১৯৭৯ সালে ১৬ জানুয়ারি দেশত্যাগ করেন মোহাম্মদ রেজা শাহ। এর সঙ্গে ইরানে বিলুপ্ত হয় আড়াই সহস্রাব্দের পারস্য রাজতন্ত্র। সে সময় মোহাম্মদ রেজা শাহ আমেরিকার আশ্রয়ে ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে আমেরিকা-ব্রিটেন কেউই মোহাম্মদ শাহকে আশ্রয় দেয়নি। অগত্যা ঠাঁই হয় তার স্ত্রী মিসরের রাজকুমারীর দেশ মিসরে।

 

‘ইসলামী বিপ্লবে’র পর- ৪৫ বছরের ইতিহাসে ইরানের আজকের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি ছাড়া সব রাষ্ট্র-প্রধানকেই কোনো না কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এদের কেউ প্রাণ হারান, কেউ নেন কারাবাস, কেউ হন দেশান্তরী...

 

‘ইসলামী বিপ্লবে’র পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন আয়াতুল্লাহ খামেনি। তিনি ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান’ এর জন্য গণভোটের ব্যবস্থা করেন এবং মানুষ তার পক্ষে ভোট প্রদান করে। নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী বাছাই করার প্রক্রিয়া অনুমোদন করে তিনি ইরানকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। তখন থেকেই আমেরিকা-ইরান বৈরী সম্পর্ক, এক সময় চিরশত্রুতায় রূপ নেয়। যার ফলে আজ আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা সামলে ইরান হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম পরাশক্তি।

ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের ৪৫ বছরের ইতিহাসে বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ছাড়া সব রাষ্ট্রপ্রধানকেই কোনো না কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন কোনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধান প্রাণ হারান। কেউবা রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমাদের নিশানা হয়ে ওঠেন। কাউকে কারাবাসে যেতে হয়। কেউবা আবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অনেককে আবার রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুনর্নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের শাসক ও তাদের রাজনৈতিক জীবন অবসানের বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক...

 

মেহেদি বাজারগান

মেয়াদকাল : ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯-৬ নভেম্বর ১৯৭৯

পদত্যাগ

ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের প্রথম (অস্থায়ী) প্রধানমন্ত্রী মেহেদি বাজারগান। তিনি একজন পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গণতন্ত্রপন্থি কর্মী। ১৯৭৯ সালের ‘ইসলামী বিপ্লবে’র অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। বিপ্লবের পর নিযুক্ত হন ইরানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি মূলত ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি মনোনীত প্রার্থী। তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখলসহ নানা বাধার সম্মুখীন হওয়ার পরও কিছু করতে না পেরে তিনি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের দুই দিন পর দেশবাসীর উদ্দেশে এক বার্তায় তিনি বলেন, যখন কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রীকেও ধর্মীয় নেতার অনুমতির প্রয়োজন হয়, তখন ব্যথা অনুভব হয়।

 

আবুল হাসান বানি সদর

মেয়াদকাল : ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০-২০ জুন ১৯৮১

বরখাস্ত এবং পলায়ন

সাইয়্যেদ আবুল হাসান বানি সদর একজন ইরানি লেখক এবং রাজনীতিবিদ। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খামেনি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য তাকে মনোনীত করেছিলেন। ফলে তিনি ইসলামী রিপাবলিক অব ইরানের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ৭৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জিতেছিলেন তিনি। ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৮১ সালের জুন পর্যন্ত সাংসদীয় দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে আবুল হাসান ইরানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তবে ‘ইসলামী বিপ্লবে’র আগে আবুল হাসান ফ্রান্সে বহু বছর বসবাস করেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি ইরানের জাতীয় প্রতিরোধ পরিষদের সহ-প্রতিষ্ঠা হিসেবে কাজ করেন। দায়িত্ব পালনকালে যুদ্ধ পরিচালনা এবং ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী রাজাইয়ের সঙ্গে তার বিরোধিতা প্রকাশ্যে আসে। ইরান-ইরাক যুদ্ধে তিনি ইরানের সামরিক বাহিনীর ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির চাওয়া ছিল আইআরজিসি (রিপাবলিকান গার্ডস) আরও বড় ভূমিকা পালন করুক। কিন্তু তিনি তৎকালীন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনির এতটাই আস্থাভাজন ছিলেন যে, তিনি সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে আবুল হাসানকে সাধারণ বাহিনীর নেতৃত্বে বসিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির তীব্র মতপার্থক্যের কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি বরখাস্ত হন। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। আবুল হাসান ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। বাকি জীবন সেখানেই কাটান।

 

মোহাম্মদ আলী রাজাই

মেয়াদকাল : ২ আগস্ট, ১৯৮১-৩০ আগস্ট, ১৯৮১

বোমা হামলায় মৃত্যু

ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের সবচেয়ে কম সময়ের রাষ্ট্রপতি ছিলেন মোহাম্মদ আলী রাজাই। ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির তীব্র মতপার্থক্যের কারণে আবুল হাসান বানি সদর বরখাস্ত হওয়ার পর তিনি ইরানের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৮১ সালের ২ আগস্ট তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র কয়েক সপ্তাহ ছিল মেয়াদকাল। কারণ, ১৯৮১ সালের ২ আগস্ট তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক বিস্ফোরণে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ বাহনারের সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। এ হামলার জন্য পিপলস মোজাহেদিন অর্গানাইজেশনকে (সাজমান-ই-মুজাহিদিন-ই-খালক) দায়ী করা হয়েছিল, যদিও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এ দায় কখনোই স্বীকার করেনি। রাজাইয়ের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ আলী হোসেইনি খামেনি। এ ছাড়াও মোহাম্মদ আলী রাজাই সাবেক রাষ্ট্রপতি আবুল হাসান বানি সদরের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার কয়েক সপ্তাহের কর্মকালে তেমন বিশেষ কিছু ছিল না। এ ছাড়াও আলী রাজাই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১১ মার্চ ১৯৮১ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৮১ পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।

 

মীর হুসেন মুসাভি

মেয়াদকাল : ১৯৮১ সাল-১৯৮৯ সাল

কারাবাস

মীর হুসেন মুসাভি খামেনেহ ছিলেন একজন ইরানি সংস্কারবাদী রাজনীতিবিদ। এর বাইরেও মুসাভি ছিলেন একজন শিল্পী এবং স্থপতি। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইরানের ৪৯তম এবং শেষ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। যদিও তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথাই ছিল না। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি আলী আকবর বেলায়েতিকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। সংসদীয় আস্থা ভোটে হেরে যান আলী আকবর। শেষ পর্যন্ত ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সেবার মুসাভির নাম প্রস্তাব করতে হয়। এমনকি তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েনে, মুসাভিকে একবার পদত্যাগও করতে হয়েছিল। আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্বে ১৯৮০ সালে সংবিধান সংশোধন করা হয়। বিলুপ্ত হয় প্রধানমন্ত্রীর পদ। এরপর রাজনীতি থেকে অবসর নেন মুসাভি। ২০ বছর তিনি জনসমক্ষে আসেননি। তবে ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হন তিনি। নির্বাচনের পরে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদকে অপসারণে বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভে সংঘর্ষের কারণে মুসাভিকে গৃহবন্দি করা হয়। ২০১৩ সালে তিনি গ্রেফতার হন। এখনো কারাগারেই আছেন তিনি।

 

আকবর হাশেমি রাফসানজানি

মেয়াদকাল : ৩ আগস্ট, ১৯৮৯-২ আগস্ট, ১৯৯৭

সন্দেহজনক মৃত্যু

ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের এই রাজনীতিবিদের সম্পূর্ণ নাম- আলী আকবর হাশিমি বাহরামানি রাফসানজানি। তিনি ছিলেন ইরানি রাজনীতিবিদ এবং লেখক। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন ছিলেন তিনি। পালন করেন ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ইরানের চতুর্থ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব। রাফসানজানি ১৯৮৯ সালে ইরানের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। তার মেয়াদের প্রথম চার বছর বেশ কঠিন ছিল। হিজবুল্লাহর মতো একাধিক সংগঠন তার সাংস্কৃতিক নীতির বিরোধিতা শুরু করে। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। ইরানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। এই দফায় প্রকাশ্যে তার- ‘অভিজাত ও মুক্ত বাজারনীতির’ বিরোধিতা করেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। তার রাজনৈতিক জীবনে আয়াতুল্লাহ খোমেনির পর তাকেই ইরানের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু ২০০৫ সালে এই রাজনীতিবিদ নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মাহমুদ আহমাদিনেজাদের কাছে হেরে যান। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের পরিষদের প্রধান ছিলেন। এক্সপিডিয়েন্সি ডিসসারমেন্ট কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও ছিলেন। ২০১৩ সালে আরও একবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে তিনি নিজের মনোনয়নপত্র জমা দেন। সাবেক সংস্কারবাদী রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ খাতামি তাকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু সেবার ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল তার মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীকালে রাফসানজানি এই পদের জন্য মনোনয়ন না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর ঠিক দুই বছর পর তিনি ইরানের সংসদের উচ্চকক্ষ অর্থাৎ মজলিস-ই-খোবরাগানের নির্বাচনে তেহরান থেকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জেতেন। ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি সুইমিং পুলে গোসল করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। যদিও তার মৃত্যুকে সন্দেহজনক বলেই মনে করা হয়। পরিবারের অভিযোগ- স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়তা যায় তার শরীরে।

 

মোহাম্মদ খাতামি

মেয়াদকাল : ৩ আগস্ট ১৯৯৭-৩ আগস্ট ২০০৫

সংস্কারকে অগ্রাধিকার

মোহাম্মদ খাতামি একজন সংস্কারবাদী রাজনীতিবিদ। যিনি ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইরানের পঞ্চম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেবার তিনি ২ কোটিরও বেশি ভোট পেয়ে ইরানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। মেয়াদের কয়েক মাসে তার সরকারের চিন্তাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ২০০১ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সংস্কারবাদী গণমাধ্যমকে ‘শত্রুর ডেটাবেজ’ বলে অভিহিত করেন এবং কয়েক ডজন প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ খাতামি বলেছিলেন, তার সরকার প্রতি ৯ দিনে একবার সংকটের মুখোমুখি হয়। ২০০৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পর, ইরানের প্রচারমাধ্যমে তার ছবি প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ফার্স নিউজ এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, তার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরে ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সংস্কৃতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ সরকারের সমালোচনা করেন।

 

মাহমুদ আহমাদিনেজাদ

মেয়াদকাল : ৩ আগস্ট ২০০৫-৩ আগস্ট ২০১৩

রাগী নেতা

মাহমুদ আহমাদিনেজাদ একজন ইরানি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ। ২০০৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ইরানের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি এক্সপিডিয়েন্সি ডিসসারমেন্ট কাউন্সিলের সদস্য। তার কট্টরপন্থি মতবাদ এবং ইরানের পারমাণবিকীকরণের জন্য তিনি ইরানে ব্যাপক পরিচিত। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তেহরানের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তার পূর্বসূরির অনেক সংস্কার পাল্টে দিয়েছিলেন। ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সঙ্গে তার সংঘাত লেগেই থাকত। তাতে অবশ্য বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি আহমাদিনেজাদ। বরং ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে ১১ দিন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যাননি। ২০১৭ সালে তৃতীয় দফায় রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন দেন। যদিও গার্ডিয়ান কাউন্সিল তা প্রত্যাখ্যান করে।

 

হাসান রুহানি

মেয়াদকাল : আগস্ট ৩ ২০১৩-৩ আগস্ট ২০২১

দুর্নীতির অভিযোগ

হাসান রুহানি একজন ইরানি ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ। তিনি একজন শরিয়া আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন কূটনীতিক এবং ইসলামী ধর্মগুরু। ২০১৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত ইরানের সপ্তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মেয়াদের শুরু থেকেই খামেনির আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেন তিনি। যদিও তিনি তার কয়েকটি পদক্ষেপের জন্য সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সমালোচনার শিকার হন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা এবং ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ (জেসিপিওএ) নামে আরেকটি চুক্তির জন্য একাধিকবার সমালোচিত হন। তার পরও ২০১৭ সালের নির্বাচনে রুহানি ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ ভোট নিয়ে পুনরায় নির্বাচিত হন। হাসান রুহানি ও তার আত্মীয়দের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল তাদের মধ্যে তার ভাই হাসান ফরিদুনও ছিলেন।

সর্বশেষ খবর