শিরোনাম
রবিবার, ২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

অ্যান্টার্কটিকায় তেল গ্যাস নিয়ে কাড়াকাড়ি

আবদুল কাদের

অ্যান্টার্কটিকায় তেল গ্যাস নিয়ে কাড়াকাড়ি

১৮২০ সালে মানুষ প্রথমবারের মতো মহাদেশটির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে; যা সম্পূর্ণরূপে বরফে আবৃত। বরফের এ রাজ্য মানুষের বসবাসের অযোগ্যও। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ এ বরফের রাজ্যকে জয় করে।  গবেষণায় জানতে পারে- এর ভূমি বরফের অনেক নিচে। সম্প্রতি সেই ভূমির নিচেও পাওয়া গেল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান...

অ্যান্টার্কটিকায় সন্ধান পাওয়া তেলের মজুত ৭০ মেট্রিক টন বা ৫১১ বিলিয়ন ব্যারেল

যুক্তরাজ্যের অভিযোগ- আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে অনুসন্ধান চালিয়েছে রাশিয়া

অ্যান্টার্কটিকা। পৃথিবীর বুকে ধবধবে সাদা এক বরফের রাজ্য। আস্ত একটি মহাদেশ। যেখানে বরফ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই! বরফের নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, এমনকি আগ্নেয়গিরিও।  বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, পৃথিবীর সব বরফের মাত্র ১০ শতাংশ রয়েছে গ্রিনল্যান্ডে। বাকি প্রায় ৮৯ শতাংশই রয়েছে অ্যান্টার্কটিকায়। এটি এমন এক মহাদেশ- যেখানে নেই আর্দ্রতা। এই মহাদেশের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯৫০০ ফুট উঁচুতে। ফলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণও স্বাভাবিকের চেয়ে কম। এমন দুর্গম মহাদেশে তেল ও গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অনুসন্ধান সংস্থা রসজিও (Rosgeo)। যারা ভূকম্পন এবং এ-সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে।

সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য টেলিগ্রাম’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অ্যান্টার্কটিকায় বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাসের মজুত পাওয়া গেছে। রসজিও (Rosgeo) নামের একটি রাশিয়ান অনুসন্ধান সংস্থা এমন তথ্য মস্কোকে জানিয়েছে। ওই প্রতিবেদনের দেওয়া তথ্য আবার যুক্তরাজ্যের হাতেও এসেছে। এরপর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তেল-গ্যাসের মজুত পাওয়া অঞ্চলকে নিজেদের অঞ্চল বলে দাবি করে আসছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গবেষণা সংস্থা রসজিও এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে বিবৃতিতে এমন তথ্য প্রকাশ করেছে; যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আবার নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের অভিযোগ, রুশ সংস্থাটি আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করেই সেখানে অনুসন্ধান চালিয়েছে। মস্কোর কাছে হস্তান্তর করা রাশিয়ার গবেষণা সংস্থা রসজিওর তথ্য অনুযায়ী, অ্যান্টার্কটিকায় পাওয়া তেল ও গ্যাসের মজুত প্রায় ৭০ মেট্রিক টন বা ৫১১ বিলিয়ন ব্যারেল। এই পরিসংখ্যান গত ৫০ বছরে উত্তর সাগর থেকে যে পরিমাণ তেল উত্তোলন করা হয়েছে, তার প্রায় ১০ গুণ।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় যুক্তরাজ্য রাশিয়া থেকে পাওয়া প্রতিবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে যে, রাশিয়া অ্যান্টার্কটিকায় খনির ওপর আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে কি না। অর্থাৎ এই অঞ্চলে যুক্তরাজ্যের শাসনের ওপর ১৯৫৯ সালের অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি এবং ১৯৯১ সালের পরিবেশ সুরক্ষা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে কি না তা খতিয়ে দেখছে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ফ্ল্যাগশিপ মেরু গবেষণা জাহাজ ‘একাডেমিক আলেকজান্ডার কারপিনস্কির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার  কারণে রাশিয়ার অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ আরও বেড়েছে। যা ছিল রাশিয়ার গবেষণা সংস্থা রসজিওর দ্বারা পরিচালিত। তাদের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে খনিজের মজুত খুঁজে পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে ১৯৫৯ সালের অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি দ্বারা সুরক্ষিত রাখা হয়। যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, অ্যান্টার্কটিকায় সব খনিজ বা তেলের মজুত উত্তোলন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, গত সপ্তাহে তথ্য-প্রতিবেদন যুক্তরাজ্যের কমনস এনভায়রনমেন্টাল অডিট কমিটির কাছে প্রমাণসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। যে এলাকায় তেল গ্যাস মিলেছে, যুক্তরাজ্যের দাবি সে এলাকা তাদের অধীনে। রুশ অনুসন্ধান সংস্থার বিরুদ্ধে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ ও অনুসন্ধানের অভিযোগ তোলে দেশটি। মূলত যুক্তরাজ্যের স্বার্থগুলো দেশটির পররাষ্ট্র দফতর তত্ত্বাবধান করে থাকে। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার উদ্দেশ্য হলো- আগত সংকটকে উপেক্ষা করা। অথচ কয়েকদিন আগে যুক্তরাজ্যের কমনস এনভায়রনমেন্টাল অডিট কমিটিকে দেশটির মন্ত্রী ডেভিড রুটলি বলেছিলেন, শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো হচ্ছে রাশিয়ার এমন আশ্বাসকে তারা বিশ্বাস করেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, রাশিয়া সম্প্রতি অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির মূল উপাদানগুলোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। ডেভিড রুকলি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসের একজন মুখপাত্র। এমনকি তিনি অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির মূল স্বাক্ষরকারী ব্রিটিশ সদস্য।

যদিও FCDO যোগ করে জানিয়েছে, অ্যান্টার্কটিকায় প্রচুর খনিজ সম্পদ রয়েছে। তবে রাশিয়ার অনুসন্ধানকারী সংস্থা রসজিও ‘অ্যান্টার্কটিকা নীতিমালা’ লঙ্ঘন করেছে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। এর আগেও রাশিয়ার অ্যান্টার্কটিকায় ভূতত্ত্বের জরিপ ও মানচিত্রের দীর্ঘস্থায়ী কর্মসূচি রয়েছে। রাশিয়া বারবার আশ্বাস দিয়েছে যে, ‘তাদের কার্যক্রমগুলো শুধু বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।’ ২১ মে রাশিয়ার বার্ষিক ‘পোলার এক্সপ্লোরারস ডে’র পর রসজিও একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, অ্যান্টার্কটিকায় সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর বাইরে কিছু নয়।

কিন্তু রাশিয়াকে গোটা ইউরোপ বিশ্বাস করে না। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের উদাহরণ টেনে ‘রাশিয়াকে আর বিশ্বাস করা যায় না’ বলে অনেক বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছিলেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে অ্যান্টার্কটিকা বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সংসদের পরিবেশগত নিরীক্ষা উপকমিটির কাছে যারা প্রমাণ সরবরাহ করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন লন্ডনের রয়্যাল হলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লাউস ডডস। যিনি ‘দ্য অ্যান্টার্টিকা’র একজন বিশেষজ্ঞও। ক্লাউস ডডস বলেন, আমার মনে হচ্ছে, রাশিয়ানরা ওই অঞ্চলে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান করছে। এই বিশেষজ্ঞ এও প্রমাণ করেছেন যে, রাশিয়ার কার্যক্রম প্রকৃত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের চেয়ে তেল এবং গ্যাসের মজুত সন্ধানের বেশ কাছাকাছি ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অনলাইন জার্নাল ডেইলি ম্যাভেরিকের প্রতিবেদনের পর EAC যুক্তরাজ্যের অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলের স্বার্থে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মস্কোর কার্যকলাপকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে অ্যান্টার্কটিকায় কেপটাউনের জরিপ পরিচালনাকারী একটি জাহাজ নোঙর করার পর রাশিয়ার অনুসন্ধানকারী সংস্থার জাহাজের কার্যকলাপের ওপর নজর রেখেছিল।

ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক টেরিটরি (BAT) বা অ্যান্টার্কটিকায় যুক্তরাজ্যের অঞ্চল  হলো- ১৪টি বিদেশি অঞ্চলগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। যা অ্যান্টার্কটিকার সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত। এই অঞ্চলটির ৯৯ শতাংশই বরফে ঢাকা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাগৈতিহাসিক অতীতে অ্যান্টার্কটিকার এই অঞ্চলে উষ্ণ জলবায়ুর পরিবেশ ছিল। তারা আরও জানিয়েছেন, এখানে প্রচুর গাছপালাসহ সম্ভাব্য জীবাশ্ম জ্বালানি জমা হয়ে থাকতে পারে। এটি দক্ষিণ মেরু থেকে উত্তর-পশ্চিমে প্রসারিত, অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপ এবং ওয়েডেল সাগরের কাছাকাছি অবস্থিত। তেল ও গ্যাস মজুতের সন্ধান পাওয়া স্থানটি ঐতিহাসিকভাবে সেই জায়গা হিসেবে বিখ্যাত, যেখানে আর্নেস্ট শ্যাকলটনের জাহাজ এন্ডুরেন্স ডুবে গিয়েছিল।

তথ্যসূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ

 

অন্যরকম অ্যান্টার্কটিকা

অ্যান্টার্কটিকা মানেই বরফের রাজ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম মহাদেশ। যেখানে বরফ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই! বরফের নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত থেকে শুরু করে আগ্নেয়গিরি! দুর্গম এই বরফের রাজ্যে ছয় মাস আকাশে সূর্যের দেখা মেলে আর বাকি ৬ মাস অন্ধকার। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, প্রায় ৫ কোটি বছর আগে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের জন্ম। তখন অ্যান্টার্কটিকা সবুজ বটে, তবে তা শুধু অ্যান্টার্কটিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পৃথিবীর সব ভূমি তখন দুটি মহাদেশে বিভক্ত ছিল।

দক্ষিণ গোলার্ধের অঞ্চলটি একই সঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম, শুষ্কতম এবং উচ্চতম মহাদেশ। রুশ অভিযাত্রী মিখাইল লাজারেভ ও ফাবিয়ান গটলিয়েব ফন বেলিংশসেন সর্বপ্রথম এর অস্তিত্ব উদ্ভাবন করেন। অ্যান্টার্কটিকা শব্দটি গ্রিক যৌগিক শব্দ। যার সহজ মানে হলো উত্তরের বিপরীতে অবস্থিত। ১ কোটি ৪২ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর এই পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশে নেই কোনো দেশ। আস্ত একটা মহাদেশ হলেও এখানে স্থায়ীভাবে মানুষ বসবাস করে না। তেমন সুযোগও নেই। এমনকি এই মহাদেশের অনেকাংশে এখনো পা পড়েনি মানুষের। তবে অ্যান্টার্কটিকায় গ্রীষ্ম মৌসুমে ৪ হাজারের মতো পর্যটক আসেন এবং শীত মৌসুমে এই সংখ্যাটা হাজারের নিচে নেমে আসে। কারণ শীতকালে এখানে তাপমাত্রা মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়! এর বাইরেও বরফের রাজ্যটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রিসার্চ স্টেশনগুলোয় গবেষণার সুবাদে বছরে অন্তত ৫ হাজার মানুষ অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থান করে থাকেন। তবুও অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে এই মহাদেশের।

 

অ্যান্টার্কটিকার বরফ কত পুরু?

অ্যান্টার্কটিকা মূলত কঠিন বরফের এলাকা। বরফের রাজত্ব প্রায় ৫৪ লাখ বর্গমাইলেরও বেশি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। এ কারণে এটি পৃথিবীর পঞ্চম বড় মহাদেশ। অ্যান্টার্কটিকার বরফের প্রধান পুরুত্ব প্রায় ২১৬ কিলোমিটার; যা ৭ হাজার ফুটেরও বেশি। এখানে বরফের যে স্তর রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে কম পুরু স্তর হচ্ছে প্রায় এক কিলোমিটারের। অ্যান্টার্কটিকার ভূমি প্রকৃতপক্ষে বরফের স্তর থেকে অনেক নিচে।

 

মিলেছে গোপন হ্রদের সন্ধান :

এখান পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকায় প্রায় ৩০০টি হ্রদের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, অ্যান্টার্কটিকার একটি গোপন হ্রদ রয়েছে- বাস্তবে এর সংখ্যাটা অনেক বেশি। অর্থাৎ অনেক গোপন হ্রদ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা হ্রদ খুঁজে পেতে অ্যান্টার্কটিকার ওপরে ঘন হিমবাহের বরফের নিচে ড্রিল করেছিলেন। দর্শনীয় লুকানো হ্রদগুলো এই অঞ্চলের অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি মাত্র। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো- এসব হ্রদে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা হ্রদের পানির নমুনাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন যে, এ রকম কঠোর পরিবেশে কীভাবে ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো বেঁচে থাকে।

 

অ্যান্টার্কটিকার বিশাল পর্বতমালা :

‘দ্য ট্রান্সঅ্যান্টার্কটিক পর্বতমালা’ নামের বিশাল একটি পর্বত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে পূর্ব এবং পশ্চিম অঞ্চলে বিভক্ত করেছে। এর একটি বড় অংশ বরফ এবং তুষারের নিচে চাপা পড়ে আছে। এর মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পর্বতমালাও রয়েছে। আয়তনে যা ২ হাজার মাইলেরও বেশি বিস্তৃত।

 

নেই কারও মালিকানা

১৯৫৯ সালে অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি সই হয়েছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে ওই মহাদেশকে যুদ্ধ, অস্ত্র ও পরমাণু বর্জ্য থেকে মুক্ত রাখতে একমত হয়েছিলেন বিশ্বের নেতারা। অ্যান্টার্কটিকা চুক্তিতে বলা হয়, এই অঞ্চলে কোনো একক দেশের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। বরং সব দেশের বিজ্ঞানীরা মিলেমিশে সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করবেন। তাই অঞ্চলটির ‘শান্তি ও বিজ্ঞানের জন্য নিয়োজিত প্রাকৃতিক সংরক্ষিত এলাকা’ হিসেবে ধরে রাখতে একমত হন নেতারা। এরপর ১৯৭৬ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে অ্যান্টার্কটিকায় প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ চালানোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

 

মিঠা পানির রাজ্য

পানির অন্য নাম জীবন। এই পানিকে ঘিরে পৃথিবীর বুকে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি। কিন্তু পৃথিবীতে যত পানি আছে, তার প্রায় ৯৭.৫ শতাংশ পানের অযোগ্য বা চাষের অযোগ্য। আর মিঠা পানির পরিমাণ মাত্র আড়াই শতাংশ। যার সবচেয়ে বড় উৎস অ্যান্টার্কটিকা। পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ স্বাদু পানি রয়েছে এ মহাদেশে। যার অধিকাংশ পানি বরফ আকারে রয়েছে। তাই অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলিয়ে পানও করা যাবে। পানযোগ্য পানির ক্রমাগত হ্রাসের এই দুরবস্থায় অনেকেই সমাধান হিসেবে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলিয়ে পানের পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু সে চেষ্টা করা উচিত হবে না একদমই। কারণ অ্যান্টার্কটিকা এত বিশাল আর এখানে এত পরিমাণ বরফ আছে যে, অ্যান্টার্কটিকার বরফ যদি গলে যায় তাহলে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ ২০০ ফুট বৃদ্ধি পাবে। ফলে স্থলভাগ যেখানে আমরা বসবাস করি তার অনেক স্থানই পানির নিচে তলিয়ে যাবে।

 

দুর্গম অ্যান্টার্কটিকায় রিসার্চ স্টেশন!

অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯৫০০ ফুট উঁচুতে। এখানকার বাতাসে আর্দ্রতা নেই। ফলে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে চর্মরোগ ও ডিহাইড্রেশনে। এমনকি এখানে অক্সিজেনের পরিমাণও স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তাই সত্যিকার অর্থে এখানে কোনো স্থায়ী বসতি নেই। অ্যান্টার্কটিকায় গ্রীষ্মকালের ৩০টি ক্যাম্প ছাড়াও প্রায় ৪৫টি স্থায়ী রিসার্চ স্টেশন বা গবেষণাগার রয়েছে। যেখানে উষ্ণ মৌসুমে সর্বোচ্চ ১২০০ জন পর্যন্ত থাকেন। এসব গবেষণাগারে এই মহাদেশীয় প্রাণীদের জীবন-ব্যবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান, তাপমাত্রা এবং ভূকম্পন নিয়ে নানা রকমের গবেষণাগুলো করা হয়। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া অ্যান্টার্কটিকার দুর্গম বরফের ওপর স্থাপন করেছিল ভস্টক নামের এক গবেষণা কেন্দ্র। ভস্টক স্টেশন নামেই এর পরিচিতি। এটি দক্ষিণ মেরুর কাছে, ‘পোল অব কোল্ড’ বা শীতল বিন্দুতে স্থাপন করা হয়েছে। এখানকার তাপমাত্রা -৮৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই বিন্দুটাই হলো পৃথিবীর শীতলতম স্থান। প্রতিটি স্টেশনের রয়েছে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য। তবে এগুলো এমনভাবে তৈরি যেন প্রচণ্ড বৈরী পরিবেশ থেকে গবেষকদের রক্ষা করতে পারে। ইন্টারনেট সুবিধাও রয়েছে অ্যান্টার্কটিকায়। তবে তা খুবই সীমিত। কঠিন পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও মহাদেশটি গবেষক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য আদর্শ স্থান। গ্রীষ্মকালে তো বটেই, শীতকালেও এখানকার আকাশ পরিষ্কার থাকে। ফলে পৃথিবীর কক্ষপথ, গ্রহ-নক্ষত্র, তারকা স্পষ্ট দেখা যায়। ২০১৯ সালে ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি নেওয়া ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের একাংশ আছে এ মহাদেশে।

 

অ্যান্টার্কটিকায় শহর!

অ্যান্টার্কটিকায় কোনো অধিবাসী নেই। এটি একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, যা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা। এক সময় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় গাছ, পশুপাখি ছিল। বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধীরে ধীরে। শুধু টিকে যায় শীত সহ্য করতে পারা উদ্ভিদ ও প্রাণীরা। এভাবে ধীরে ধীরে প্রায় প্রাণহীন মহাদেশে পরিণত হয় অ্যান্টার্কটিকা। শেষ প্রায় ২৫ লাখ বছর আগে এ বরফমেরু পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে জীবনধারণের উপযোগিতা। কিন্তু প্রথম দিকে অ্যান্টার্কটিকায় ভ্রমণকারীরা ক্রুজ জাহাজে থাকতেন। বিজ্ঞানী ও গবেষকরা রিসার্চ স্টেশনে কাজ করতেন। তবে এখন এই মহাদেশেও রয়েছে মানুষের বসবাস। রয়েছে একটি শহর- যা চিলির অধিবাসীদের গবেষণার স্থান। মধ্য অ্যান্টার্কটিকার শহরটির নাম ভিলা লাস এস্ট্রেলাস। ইংরেজিতে ‘দ্য স্টারস টাউন’। অ্যান্টার্কটিকার কিং জর্জ দ্বীপের বিচ্ছিন্ন একটি শহর। আর্জেন্টিনার এসপেরেঞ্জা বেজের সঙ্গে এর তুলনা করা হয়। এসপেরেঞ্জার চেয়েও বড় এই দ্বীপ শহরটি।

 

বরফে আগ্নেয়গিরি!

অ্যান্টার্কটিকায় প্রচুর বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে, তবে দুটি সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষকরা এই অঞ্চলে বরফের নিচে অবিশ্বাস্যভাবে আকর্ষণীয় এবং বিরল ধরনের আগ্নেয়গিরির সন্ধান পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার জমাট বরফের নিচে একসঙ্গে ৯১টি আগ্নেয়গিরির সন্ধান পেয়েছেন। গবেষকদের মতে, এগুলো তুলনামূলক নতুন এবং কোনো দিনই দিনের আলো দেখেনি। তাদের শঙ্কা, এগুলোতে অগ্ন্যুৎপাত হলে বরফ স্তরে ধস নামতে পারে। যার প্রভাবে পানির স্তর বাড়তে পারে। ফলে ভূপৃষ্ঠের একটা বড় অংশ পানির তলায় যেতে পারে। তবে কিছুটা আশার আলোও পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বর্তমানে আগ্নেয়গিরিগুলো সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। এই মুহূর্তে এগুলোর জেগে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। আসলে আগ্নেয়গিরিগুলো সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। আগ্নেয়গিরিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির উচ্চতা প্রায় ৪ হাজার মিটার। যা উচ্চতায় সুইজারল্যান্ডের ইগার আগ্নেয়গিরির সমান। নতুন আবিষ্কৃত এই আগ্নেয় পার্বত্য অঞ্চলে ১০০ থেকে ৩৮৫০ মিটারের পাহাড়ের সন্ধান মিলেছে। ম্যাক্স ভ্যানের কথায়, ‘আগ্নেয়গিরিগুলোর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০-৪০০০ মিটার পর্যন্ত। সবগুলোই বরফে ঢাকা। ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু বরফের নিচে ঢাকা রয়েছে এসব আগ্নেয়গিরি।’ এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলটির প্রধান ম্যাক্স ভ্যান সতর্ক করে বলেছেন, ‘উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলতে শুরু করলে অগ্ন্যুৎপাত এড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।’

 

সর্বশেষ খবর