রবিবার, ১৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঈদুল আজহা দেশে দেশে

তানভীর আহমেদ

ঈদুল আজহা দেশে দেশে

একেক দেশে একেক নাম

কোরবানি অর্থ উৎসর্গ। এই উৎসর্গের মূল্যায়ন আর্থিক ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় একমাত্র আল্লাহর ভীরুতার ওপর। কোরবানি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে। কোরবানি শব্দটি এসেছে ‘কুরব’ শব্দ থেকে, যার অর্থ নৈকট্য, সান্নিধ্য ও নিকটবর্তী হওয়া। কোরবানির মাধ্যমে হালাল পশু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে তাঁর নিকটবর্তী হওয়া। কোরবানি করার জন্য নির্দেশ রয়েছে সুরা কাউসারে। আমাদের দেশে কোরবানির ঈদের পরিচিতি ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ নামে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর আরও অনেক নাম আছে। মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, মিসর এবং লিবিয়ায় কোরবানির ঈদকে বলা হয় ঈদুল কিবির। আফ্রিকার অনেক এলাকায় এর পরিচয় তাবাসকি বা তোবাসকি নামে। নাইজেরিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকায় পরিচিত বাব্বার সালাহ নামে। সোমালিয়া, কেনিয়া এবং ইথিওপিয়ায় বলা হয় সিডওয়েনি। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং পাকিস্তানে ঈদুল আজহাকে বলা হয় বকরি ঈদ। এসব দেশের বেশির ভাগ মানুষ ছাগল-ভেড়া দিয়ে কোরবানি করে। একমাত্র ইন্দোনেশিয়াতেই বলা হয় ঈদুল আজহা। তুরস্কে বলা হয় কোরবান বেরামি বা ত্যাগের উৎসব। অন্যদিকে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, আলবেনিয়া এবং বুলগেরিয়ায় বলা হয় কোরবান বাজরাম। কাজাখস্তানে বলা হয় কোরবান এইত। কুর্দিশরা বলে সেজনা কোরবানে। আফগানিস্তানে আছে কয়েকটি নাম। দারি ভাষার লোকেরা বলে ঈদ-ই কোরবান। পোশতু ভাষার লোকেরা বলে লয় আখতার বা কোরবানি আখতার। আফ্রিকারই আরেকটি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় একে বলা হয় ‘বকরি ঈদ’। অনেকটা ভারত আর পাকিস্তানের মতোই। ইন্দোনেশিয়ায় এর নাম ‘ঈদুল আদহা’ হলেও মালয়েশিয়ায় বলা হয় ‘আইদিল আদহা’। আবার একে ‘হাজি হারিরাইয়া’ বা ‘হারিরাইয়া কুরবান’ নামেও মালয়েশিয়ায় ডাকা হয়। এর অর্থ- ত্যাগ স্বীকারের উৎসব। এদিকে কুর্দিরা বলে ‘সেজনা কুরবান’। কোরবানির ঈদ একেক দেশে একেকভাবে পালিত হয়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এ ধারা একই রকম।  ঈদের নামাজের পরপরই মুসলমানরা তাদের পশু নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যান। হোক সেটা রাস্তা অথবা কোনো খেলার মাঠ। আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান ও মালদ্বীপে একই চিত্র।

 

নিউইয়র্কে ঈদ জামাতে ভিড়

নিউইয়র্কে বেশ জাঁকজমকভাবে কোরবানির ঈদ পালন করা হয়। পাবলিক স্কুলগুলোও ছুটি রাখা হয় সেদিন। নিউইয়র্কে ৮০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির বসবাস। পশু কোরবানি ছাড়াও এই দিনে নিউইয়র্কে উৎসবের আমেজ লেগে থাকে সারা দিন। সকালে ঈদের নামাজের বিশাল জামাত হয় জ্যামাইকায়। শহরের ম্যানহাটন, জ্যাকসন হাইটস, উডসাইড ও ব্র“কলিন এলাকায় বাংলাদেশিদের পরিচালিত জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার (জেএমসি) হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় জামাতটি।

প্রায় ১৫ হাজার মুসল্লি জামাতে অংশ নেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি, কানেটিকাট, ম্যারিল্যান্ড, পেনসিলভেনিয়া, ভার্জিনিয়া, ওয়াহিও, ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলিনা, সাউথ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, মিশিগান, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যগুলোয় ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়।

 

রাস্তায় নেমে আসে সবাই

মিসরে ঈদুল আজহার উৎসব শুরু হয় ঈদের দিন ভোর থেকেই। সকাল বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে ছেলে-বুড়ো সবাই। কোরবানির পশুর সামনে তারা ভিড় করেন। শিশুদের জন্য নানা ধরনের খেলনা-বেলুন নিয়ে পসরা সাজায় বিক্রেতারা। মহিলাদের দেখা যায় গয়না ফেরিওয়ালার কাছ থেকে দরদাম করে কেনাকাটা করতে। সকাল ৬টার মধ্যে মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ পড়তে উপস্থিত হন মুসল্লিরা। নামাজ শেষ হলেই বাচ্চাদের দেখা যায় বাবা-মায়ের কাছে নানা বায়না নিয়ে ছুটে যেতে। কোরবানি দেওয়ার জন্য ছুরি ধার দেওয়ার দৃশ্যও পরিচিত মিসরে। ঈদের দুই সপ্তাহ আগে থেকেই ছুরির দোকানে, পশুর হাটে ভিড় দেখা যায়।

 

অস্ট্রেলিয়ায় অন্যরকম ঈদ

ঈদুল আজহার দিন অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি ছুটি থাকে না। তবে ইসলামিক স্কুল, সামাজিক ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলো এ দিনটিতে বন্ধ থাকে। অস্ট্রেলিয়ার মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস প্রধানত সাবারবান শহরকে কেন্দ্র করে। এখানে আলাদা কোরবানির পশু কিনে লালন-পালন করার সুযোগ না থাকায় কয়েকটি পরিবার মিলে একজনকে পশু কেনার এবং যত্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঈদের দিন সকালে মুসলমানরা মসজিদে নামাজ আদায় করেন। তারপর কোরবানি দিয়ে গোশত এবং চামড়ার টাকা গরিবদের মধ্যে দান করেন। মুসলমান ছাড়াও অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও এই গোশত উপহার হিসেবে দান করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানরা এ দিন ‘বাকলাঙা’ এবং ‘লোকুম’ নামের দুটি তার্কিশ ডিম রান্না করেন।

 

মালয়েশিয়া অতিথি আপ্যায়নে সেরা

মালয়েশিয়ার জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলমান। তাই ঈদুল আজহায় গোটা মালয়েশিয়াতেই উৎসবের ছোঁয়া দেখা যায়। সকালে ঈদ জামাত ও পশু কোরবানির পর নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে ঈদ পালন করতে দেখা যায় তাদের।

সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের এই পরিচিত দৃশ্য অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। শিশুদের জন্য পিঠা জাতীয় খাবার বানানো হয়। প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের দাওয়াত দিয়ে কোরবানির পশুর মাংস রান্না করে আপ্যায়ন করা হয়। এই দিনে মালয়েশিয়ার মুসলমান পরিবারগুলোর দরজা সব সময় সবার জন্য খোলা থাকে। সবাইকে আপ্যায়ন করে তারা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পছন্দ করে।

 

কোরবানির অর্ডার নেওয়া হয় লন্ডনে

যুক্তরাজ্যে মুসলমান আছেন প্রায় ৩০ লাখ। যা মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ ভাগ। অধিকাংশ মুসলমানই ইংল্যান্ড ও ওয়ালেসে বসবাস করেন। যুক্তরাজ্যের মুসলমানরা খুব বেশি ধর্মভীরু নন। যারা কেবল মসজিদ ও তাবলিগ জামাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারাই দৃঢ়ভাবে ইসলাম ধর্ম পালন করে থাকেন। দুই ঈদে মুসলমানরা ট্রাফালগার স্কয়ারে মিলিত হন এবং ঈদ উদযাপন করেন। তবে সেখানকার ঈদ বাংলাদেশ বা উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো তেমন আড়ম্বরপূর্ণ হয় না। যুক্তরাজ্যে প্রকাশ্যে পশু জবাই করা নিষিদ্ধ। তাই ঈদে নির্ধারিত এলাকায় সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান থেকে কোরবানি দেওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে অনেক এশিয়ান গ্রোসারি ঈদের সময় কোরবানির জন্য আগ্রহীদের নাম সংগ্রহ করে থাকে। ঈদের প্রায় এক মাস আগে থেকে দোকানে দোকানে সাইনবোর্ড ঝোলানো থাকে : ‘এখানে কোরবানির অর্ডার নেওয়া হচ্ছে’। এর অর্থ হচ্ছে এখানে নাম লিখিয়ে প্রতি নামের বিপরীতে অর্থ দিয়ে যেতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোরবানির পর গরু বা ভেড়ার গোশত ঈদের পরের দিন প্রাহকদের কাছে সরবরাহ করে তারা।

 

ইন্দোনেশিয়ায় কেবল হাজিরাই কোরবানি দেন

আয়তনের দিক দিয়ে ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ। পোশাকে ইউরোপিয়ানের মতো হলেও এখানকার বেশির ভাগ মানুষ নামাজ পড়েন। এরা ধর্মভীরু কিন্তু কোনো রকম ধর্মীয় গোঁড়ামি কাজ করে না। রোজার ঈদ খুব আনন্দের সঙ্গে পালন করলেও কোরবানিটা এরা কোনো রকমে কাটিয়ে দেন। ইন্দোনেশিয়ায় সাধারণত যারা হজ করেছেন কেবল তারাই কোরবানি দেন এবং শুধু তাদের ওপর নাকি কোরবানি ফরজ। গরু বা ছাগল কিনে হাজিরা এলাকার মসজিদে দিয়ে দেন। এ রকম করে দেখা যায় একটা মসজিদে দুই-একটা গরু এবং ৮/১০টা ছাগল জমা হয়। মসজিদের ইমাম ওই এলাকায় ঘর হিসাব করে কোরবানির গোশত ভাগ করে দেন সমানভাবে। যাদের অবস্থা ভালো তারা ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, আমি গোশত কিনতে পারি, তাই আমার অংশটা গরিব কাউকে দিয়ে দাও। এর বাইরেও কেউ কোরবানি দিলে সেটাতেও কোনো বাধা-নিষেধ নেই।

 

আলোকসজ্জায় সাজে আরব আমিরাত

আরব আমিরাতে প্রাইভেট অফিসগুলোতেও ছুটি ঘোষণা করা হয়। ধনী দেশ, বিলাসী আয়োজনে পটু সেখানকার মানুষ। ঈদ জামাতের পর কেউ কেউ কোরবানির পশুর কাছে গিয়ে থাকেন। দেশের বড় বড় শপিং মল নানা ধরনের বিনোদন আয়োজন থাকে। অনেকে আবার বাচ্চাদের নিয়ে এ দিন ছুটে যান ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। আবুধাবিতে ক্যাসাড নাচের অনুষ্ঠানগুলোয় বাচ্চাদের নিয়ে হাজির হন তাদের বাবা-মা। শহরজুড়ে আলোকসজ্জা দেখতে অনেকেই রাতে বের হন। রাস্তাগুলো ছেয়ে যায় রঙিন বাতির ঝলকানিতে। ধনীরা দান করার জন্য এদিন খোলা মনে বের হন। কেউ দান সহায়তা চাইলে তারা না করেন না।

 

মরক্কোয় উপহার নিয়ে হাজির প্রিয়জনের বাসায়

মরক্কোয় ঈদ জামাতের প্রথম সারিতে দাঁড়াতে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ভিড় করেন। অনেকেই চেষ্টা করেন বাসা থেকে বাড়তি জায়নামাজ নিয়ে আসতে। মরক্কোর ‘হাসান-টু’ মসজিদ প্রাঙ্গণে হাজার হাজার মুসল্লির নামাজ শেষে দরিদ্রদের মাঝে দান করতে দেখা যায়। কোরবানির পশুর মাংস রান্না করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেতে পছন্দ করেন মরক্কোবাসী।

তাই মাংস তৈরি ও রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত দিন কাটে তাদের। এ ছাড়া খাবার টেবিলে দেশীয় ফল ও ঐতিহ্যবাহী রান্নার আইটেম হাজির করেন গৃহকর্ত্রীরা। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পুরো শরীর ঢাকা পোশাক পরে তারা বাইরে বেড়াতেও পছন্দ করেন। প্রিয়জনদের জন্য মিষ্টি ও বিভিন্ন উপহার নিয়ে হাজির হন তাদের বাসায়।

 

ঈদে ছুটি নেই জার্মানির মুসলমানদের

বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ঈদে ছুটি মেলে না। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয় যতটা আড়ম্বরভাবে ঈদুল আজহা পালন করতে দেখা যায়, সে দৃশ্য নেই জার্মানিতে। সেই দেশে মুসলিম মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৯ শতাংশ। অধিকাংশই ভিন্ন ধর্ম পালন করেন। এ কারণেই জার্মান মুসলমানরাও দুই ঈদসহ কোনো ধর্মীয় উৎসবে সরকারি ছুটি পান না। যেসব মুসলমান সরকারি চাকরিজীবী তাদের খ্রিস্টান সহকর্মীদের ধর্মীয় উৎসবে ছুটি দেওয়া হলেও মুসলমানরা তা পান না। ওখানে কেবল খ্রিস্টধর্মীয় উৎসবেই জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। জার্মানির অধিকাংশ মুসলমান বার্লিনে বা শহরাঞ্চলে থাকেন। তারা ওখানেই ঈদের নামাজ আদায় করেন।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর