রবিবার, ২৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

যেভাবে আওয়ামী লীগের অভ্যুদয়

শ ম রেজাউল করিম

যেভাবে আওয়ামী লীগের অভ্যুদয়

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ রাজনৈতিক দল। দলটি একদিকে যেমন অসাধারণ নেতৃত্ব ও জনআকাক্সক্ষার রাজনীতি চর্চার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ, অন্যদিকে তেমনি বাঙালি জাতির অনন্য সব অর্জনের গর্বিত অংশীদার। এ রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরেই এক দিন শোষণ আর বঞ্চনার অবসানে মুক্তিকামী বাঙালি স্বাধিকারের স্বপ্ন বুনেছিল। আর আজ বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতিটি সোপানে, বিশ্বদরবারে বাঙালির মাথা উঁচু করা দাঁড়াবার প্রতিটি উপলক্ষে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম। তাই প্লাটিনাম জুবিলির এই মাহেন্দ্রক্ষণে খানিকটা পৌঢ়ত্বেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিতে পূর্বের সমলয়ে প্রাসঙ্গিক, সমান দাপুটে। বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার প্রাপ্তিতে রূপায়ণ, নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাওয়া, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট দেশে রূপান্তর-প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনিবার্যতা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যে দলটির আত্মপ্রকাশ হয়েছিল, সেটিই আজকের আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্রমেই জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি। আর এ দলটি সংগঠিত করা থেকে শুরু করে গৌরবময় উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত যিনি ছিলেন মূল চালিকাশক্তি, তিনি রাজনীতির কবি, ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ জনমানুষের আকাক্সক্ষা পূরণের বাতিঘর আর মুক্তিপাগল বাঙালির আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। বাঙালি জাতির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুধু প্রাসঙ্গিকই নয় বরং অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের সৃষ্টি ও ধারাবাহিক সমৃদ্ধি একই সূত্রে গাঁথা। পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর আবার বিপর্যয়ের মুখে পড়া বাংলাদেশকে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করেছেন বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের সুযোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা। এখানেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম। আধুনিক ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা একই বৃন্তে অবিচ্ছিন্ন সত্তা।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একটুখানি ফিরে দেখাটা এখানে প্রাসঙ্গিক বটে। চল্লিশের দশকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে জনমুখিতার প্রশ্নে বিভক্তি দেখা দেয়। সে সময় ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরম খাঁ এবং খাজা নাজিমউদ্দিন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী উদারপন্থি নেতারা সে সময় অবহেলিত হয়ে পড়েছিলেন। তখন তারা ঢাকার মোগলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মীশিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে তখনকার তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন টাঙ্গাইলের একটি আসনের উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়া মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শামসুল হকের নির্বাচনি ফলাফল নির্বাচন কমিশন অবৈধ ঘোষণা করলে তখন তারাও এসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী উদারপন্থি নেতাদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করেন। মুসলিম লীগের নানা নিপীড়ন-নির্যাতন উপেক্ষা করে কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে তারা ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। সেখানেই ২৩ জুন বিকালে প্রায় ৩০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। মওলানা ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন তৎকালীন কারাবন্দি তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এই ২৩ জুনকেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতারা দলের আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের প্রেক্ষাপট বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন এভাবে- “কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসে সে খবর পাই। ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে অফিস হয়েছে।....আমরা সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে খুবই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, আর মুসলিম লীগের পেছনে ঘুরে লাভ নেই। এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।....এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না।....আমাকে আরো জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হলে তাতে যোগদান করবো? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করবো না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।” এ বিষয়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন- “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দী’।”

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পেছনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য নয়। তিনি ১৯৪৭ সালের শেষদিকে বঙ্গবন্ধু সতীর্থ-সহযোদ্ধাদের নিয়ে ১৫০, মোগলটুলিতে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ সংগঠিত করেন ও ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছরের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সফল ধর্মঘটের মাধ্যমে সূচিত হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে কারারুদ্ধ ও পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেদিন অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। সে সময় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ জাগরণের একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হিসেবে তিনি দূরদৃষ্টি দিয়ে আওয়ামী লীগ সৃষ্টিকে ভেবে রেখেছিলেন। নবসৃষ্ট আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পেয়ে একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ছাত্রলীগের নতুন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রসারে মনোনিবেশ করেন। এদিকে ভাষার অধিকার আদায়ের দাবিতে নিয়মিত ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশনা দেন তিনি। নিজের দূরদর্শী চিন্তা- চেতনা, মতাদর্শ আর অসাধারণ নেতৃত্বগুণে মাত্র অল্প বয়সেই আওয়ামী লীগের অপরিহার্য মুখ হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর কথায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৫০ সালের ১৮ ও ১৯ মার্চ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন অখন্ড বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পুরো পাকিস্তানজুড়ে একটি রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর জোরালো উদ্যোগেই প্রাদেশিক দল থেকে পুরো পাকিস্তানের জাতীয় দলে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং একজন বাঙালি নেতা হিসেবে তাঁর আবির্ভাব হয়। ১৯৫৪ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করে বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত হন। এ সময় যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের ২২৩টিতে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক তৎপরতায় সুস্পষ্ট ছিল তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক সচেতনতা।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী, সভাপতি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

সর্বশেষ খবর