সোমবার, ৮ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাবা ছিলেন শ্রমিক ছেলে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী

বাবা ছিলেন শ্রমিক ছেলে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী

কিয়ার স্টারমার; দক্ষিণ ইংল্যান্ডের ছোট একটি শহরের একজন সাধারণ মানবাধিকার আইনজীবী, যিনি এখন যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী।  সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে তার বিজয় ছিল অপ্রতিরোধ্য। তবুও দেশটির খুব কম মানুষই জানেন, তিনি আসলে কে...

 

কিয়ার স্টারমার; মাত্র নয় বছর ধরে আছেন ব্রিটেনের রাজনীতিতে। ২০২০ সালে নিজ যোগ্যতায় অর্জন করেন ব্রিটেনের লেবার পার্টির প্রধানের দায়িত্ব। গত এক শতাব্দীর মধ্যে তার দল সবচেয়ে খারাপ নির্বাচনি পরাজয়ের মুখোমুখি হয়। যুক্তরাজ্যের রাজনীতির ময়দানে তলানিতে থাকা সেই দলকে প্রভাবশালীর কাতারে নিয়ে আসেন। মাত্র চার বছরে লেবার পার্টিকে ব্রিটিশ রাজনীতিতে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত করেন।

 

পরিবারের ‘সুপারবয়’

তার চেয়েও বেশি, তার সাফল্য। খুব কম মানুষই ভাবতেন, এমন রূপান্তরও সম্ভব। তার শত্রুরা একে ভাগ্য বলে উড়িয়ে দিতেই পারেন। তারা বলে যে, তিনি ঋষি সুনাকের সরকারের বিপর্যয় থেকে উপকৃত হয়েছেন। অনেকে তো এও বলে যে, স্টারমারের বিজয় মূলত রক্ষণশীলদের অজনপ্রিয়তারই প্রতিফলন। তবে সত্য আরও কৌতূহলী এবং আরও বেশি আকর্ষণীয়। ৬১ বছর বয়সি স্টারমারের একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীতের গল্পও রয়েছে। তার বাবা ছিলেন একজন নীরব, কর্তৃত্ববাদী মালিকের শ্রমিক (স্টারমারের বাবার পেশা, আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, রাজনৈতিক শ্রেণি, এমনকি কখনো কখনো ভোটারদের কাছেও এর জন্য উপহাসের পাত্র হতে হয়)। কাজ করতেন যুক্তরাজ্যের কারখানায়। একবার তো টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দর্শকরা এ নিয়ে বেশ হাসি-তামাশাও করেছিল। তবে স্টারমারও নিজের পরিচয়কে ছোট করে দেখেননি। জবাবে স্টারমার তার বক্তব্য চালিয়ে যান অনেকটা হাস্য-রসিকভাবেই। তার মা ছিলেন একজন নার্স। দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী, নানা রোগে আক্রান্ত। স্টারমার সে অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে, ‘এটি সত্য- আমার মা একজন নার্স ছিলেন। যদিও দুর্ভাগ্য তার সঙ্গে আমরা শেষ দেখা করতে পারিনি।’ তারাই লেবার পার্টির প্রথম নেতা কিয়ার হার্ডির নামানুসারে তার নামকরণ করেন। স্কুল জীবনে তিনি ছিলেন পারদর্শী। বাঁশি বাজানো, ফুটবল খেলা ছিল তার নেশা। পরবর্তীতে অবশ্য একজন তীক্ষ্ণ, চতুর আইনজীবী হয়ে ওঠেন। তার ভাইবোনেরা তাকে ‘সুপারবয়’ বলে ডাকতেন।

 

প্রচারণায় বিচক্ষণতার পরিচয়

স্টারমার ছিলেন সমাজতন্ত্রের ভক্ত। ২০১৫ সালে স্টারমারের রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয়েছিল। সেবার তিনি সেন্ট্রাল লন্ডনের ঠিক উত্তরে হলবর্ন এবং সেন্ট প্যানক্রাসের এমপি হয়েছিলেন। কিন্তু ৮৫ বছরের ইতিহাসে ২০২০ সালে নির্বাচনে লেবার পার্টি সবচেয়ে খারাপ পরাজয়ের মুখোমুখি হয়। সেখান থেকেই বামপন্থি লেবার পার্টির নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন স্টারমার। এর গল্পটি ছিল এমন- ২০১৯ সালে যখন বামপন্থি লেবার নেতা জেরেমি করবিনের পর, তিনি সেই বামপন্থি দলের নেতৃত্বের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তার পূর্বসূরি অ্যাকোলাইটদের কাছে ১০টি অঙ্গীকার দিয়ে আবেদন করেছিলেন। একবার ক্ষমতায় আসার পর, তিনি শেষ অঙ্গীকার দিয়ে সবাইকে অবাক করেন। এমনকি এর বিরোধিতাও করেছিলেন। পরে অবশ্য কর্বিনাইটস এবং অ্যান্টিসেমাইটদের পার্টি থেকে নির্মূলও করা হয়েছিল। স্টারমার বলেছেন, কভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সাধারণের আর্থিক অবস্থা তাকে তার দলের সঙ্গে এগিয়ে যেতে নিষেধ করে। তবে সত্যটি হলো- তিনি সাধারণ নির্বাচনে জিততে চেয়েছিলেন। যদিও সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে এর জন্য কোনো সমাজতান্ত্রিক পথ নেই। স্টারমার জানুয়ারিতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি নয় বছর বিরোধী দলে আছি। এটি জীবনে পরিবর্তন আনেনি। তবে এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার ছিল। লেবার পার্টিকে ওপরের সারিতে আনার চেষ্টা করেছি। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা ২০১৯ সালে আমাদের পথ হারিয়েছি। এখান থেকে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং দ্রুত এগিয়ে গেছি।’

 

সামনে বড় চ্যালেঞ্জ

কিয়ার স্টারমার; যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে বিশাল ব্যবধারে জয় পেলেও তার আগামীর পথগুলো যে বেশ কঠিন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্লেষকদের মতে, স্টারমারকে প্রথমে ব্রিটিশদের মন জয় করতে হবে। নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বে পাঁচজন সংস্কারপন্থি সংসদ সদস্যের ওপর নজর রাখতে হবে। সংস্কারপন্থি সংসদ সদস্যের দলটি বরাবরই ব্রিটেনের অভিবাসন নিয়ে সোচ্চার। বিশেষত, ছোট ছোট নৌকায় করে বিপজ্জনক চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা লোকেদের ওপর সংস্কারপন্থিরা বরাবরই নজর রাখতে চাইবে। সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকা থামিয়ে দেবেন। যদিও এই বিষয়ের বাস্তব কোনো সমাধান দেখা যায়নি।

স্টারমারের পূর্বসূরি ছিলেন লেবার পার্টির নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। যিনি ছিলেন লেবার পার্টির সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ ১০ বছর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকার পরে তিনি পদত্যাগ করেন। গত ১৪ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে ছিল লেবার পার্টি। এবার নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। ১৪ বছর পরে টনি ব্লেয়ারের সেই লেবার পার্টিকে আবারও ক্ষমতায় নিয়ে আসেন স্টারমার। যা দলের জন্য বিশাল অর্জন।

স্টারমার সতর্কতার সঙ্গে নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি খুব কমই ভুল করেন। প্রতিপক্ষের আক্রমণের শিকার যেন না হতে হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতেন। গত বছরের অক্টোবরে মানবাধিকার বিবেচনায় স্টারমার একটি বড় ভুল করে ফেলেছিলেন। ইসরায়েলে হামাসের মারাত্মক আক্রমণের চার দিন পরে সাংবাদিকরা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জেরুজালেম স্ট্রিপের পানি এবং বিদ্যুৎ লাইন কেটে ইসরায়েলি বাহিনীর গাজা অবরোধ করার অধিকার আছে কি না? উত্তরে স্টারমার বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি ইসরায়েলের সেই অধিকার আছে।’ যদিও স্টারমার আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করে এমন উত্তর দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক আইনে পানি ও বিদ্যুতের লাইন কেটে সাধারণ মানুষকে অনাহারে রাখা সাধারণত যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে নির্বাচনের কিছুদিন আগে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, সে সময় তিনি কেবলমাত্র ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ রয়েছে, এমনটা বলতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে স্টারমার নিঃশব্দে গাজা ইস্যুতে আরও বেশি সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তার দল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের জন্য চাপ দেয়। তিনি ডিসেম্বরের শুরুতে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির সঙ্গে দেখা করেন। যিনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের প্রধান মধ্যস্থতাকারী। মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। বামপন্থি সমালোচকরা স্টারমারকে আরও র‌্যাডিক্যাল নীতি ত্যাগের অভিযোগ করেছেন। যা ২০২০ লেবার পার্টির নেতা হওয়ার দৌড়ে তার প্রচার অভিযানের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল।  একটি প্রচারণার ভিডিও দিয়ে তিনি তার প্রচারাভিযান শুরু করেছিলেন। এমনকি তিনি বিশ্বাস করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, ২০০৩ সালে ব্লেয়ার-সমর্থিত ইরাক আক্রমণ বেআইনি ছিল।

 

সারা জীবন একজন প্রাপ্তবয়স্ক

১৯৬২ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন কিয়ার স্টারমার। পরিবারের চার সন্তানের একজন কিয়ের স্টারমার বেড়ে ওঠেন দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের সারে-তে। শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে তার জীবনের যোগের কথা প্রায়শই বলতে শোনা যায়। বাবা একটি কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন এবং মা ছিলেন নার্স। তার পরিবারও কট্টর লেবার পার্টির সমর্থক ছিল। বড় হয়ে ওঠার সময় স্টারমারের পারিবারিক জীবন খুব সুখকর ছিল না। দূরত্ব রেখে চলতেন তার বাবা। মা জীবনের দীর্ঘকাল ‘স্টিল’স ডিজিজ’ নামক এক ধরনের অটো-ইমিউন ডিজিজে ভুগেছেন। তবে ছেলেবেলা থেকেই স্টারমার ছিলেন প্রাপ্তবয়স্ক। স্কুলে থাকাকালীন স্টারমার বুলিংকারীদের বাধা দিতেন। একবার তো কয়েকটি দুষ্ট ছেলে একটি শিশুকে কবরস্থানে সেলোটেপে আটকে রাখতে চেয়েছিল। তিনি তাদের বাধা দেন এবং শিশুকে উদ্ধার করেন। একদিন স্টারমার বোন ক্যাটি বাল্ডউইনকে বলেছিলেন, ‘তাকে সারা জীবন বড় হতে হবে।’ তবে তার মধ্যে রসিকতাও কম নয়।  তিনি মোজার্ট, নর্দান সোল; এমনকি ছেলে হিসাবে আইলাইনারও পছন্দ করেন। তরুণ স্টারমারের ফটোগ্রাফগুলোও ছিল বেশ আকর্ষণীয়।

 

‘শান্ত প্রকৃতির স্টারমার’

স্টারমার লেবার পার্টির নির্বাচনি সমাবেশগুলো খুব একটা উপভোগ করতেন না। তিনি লাজুক প্রকৃতির। তবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রচারণায় কথা বলেছিলেন। ২০২৩ সালের পার্টি কনফারেন্সে এক ব্যক্তি স্টারমারের দিকে চকচকে কিছু একটা ছুড়ে মারে। মুহূর্তে নিরাপত্তাকর্মীরা স্টারমারের সুরক্ষাকবচ হিসেবে ঘিরে ফেলে। রংধনুর মতো চকচকে সেই জরিগুলো স্টারমারকে ‘সুপারবয়’ করে তোলে। শেষ পর্যন্ত তাকে আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল।    তিনি সাধারণত প্রতিবাদকারীদের থেকে আলাদা। ২০২১ সালে যখন বাড়িওয়ালা মহামারি বিধিনিষেধ নিয়ে তার সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি করছিল তখন বাড়িওয়ালার চশমাটি নিচে পড়ে গিয়েছিল। স্পষ্টতই স্টারমার বাড়িওয়ালার কান্ডে ক্ষিপ্ত ছিলেন।  কিন্তু তিনি তাকে তার চশমা তুলে দেন। স্টারমার শান্তভাবে তাকে তার চশমা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। স্টারমারের নেতৃত্বের প্রচারণায় যে যাই বলে থাকুন না কেন, লেবার পার্টিকে নির্বাচনে লড়ার জন্য উপযুক্ত করে দলকে মধ্যপন্থায় নিয়ে গেছেন তিনি।

অর্জনে তার ‘নাইট’ উপাধি

স্টারমার সারে-তে বেড়ে ওঠেন। ছেলেবেলার পড়াশোনা কাটে রিগেট গ্রামার স্কুলে। এটি একটি নির্বাচিত রাষ্ট্রীয় স্কুল। যা সেখানে তার ছাত্র থাকাকালীন সময়ে বেসরকারি হয়ে ওঠে। ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির স্থানীয় যুব শাখায় যোগ দেন কিয়ার স্টারমার। কিছু সময়ের জন্য উগ্র বামপন্থি একটি পত্রিকার সম্পাদনাও করেছিলেন। স্টারমার তার পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি শিক্ষা লাভ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন। লিডস এবং অক্সফোর্ডে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ব্যারিস্টার হিসেবে মানবাধিকার নিয়ে কাজও করেছেন। সেই সময় ক্যারিবিয়ান এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে মৃত্যুদন্ড বিলুপ্তির জন্য তিনি কাজ করেন। ১৯৯০-এর দশকে একটি বিখ্যাত মামলায় তিনি দুজন ইকো-অ্যাক্টিভিস্ট বা পরিবেশ আন্দোলনকারীর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যাদের বিরুদ্ধে ‘ম্যাকডোনাল্ডস’ মামলা করেছিল। ২০০৮ সালে স্টারমার পাবলিক প্রসিকিউশনের ডিরেক্টর এবং ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যার অর্থ, তিনি ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের সবচেয়ে সিনিয়র প্রসিকিউটর সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি  চাকরি করেন এবং সবশেষে ২০১৪ সালে তাকে ‘নাইট’ উপাধিও দেওয়া হয়েছিল।

 

তথ্যসূত্র : পলিটিকো ও দ্য গার্ডিয়ান

সর্বশেষ খবর