শিরোনাম
রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভয়ংকর বন্যার ইতিহাস

বিজ্ঞানীরা বারবার বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ভবিষ্যতে এই গ্রহের মানুষ ঘন ঘন বিধ্বংসী বন্যার দেখা পাবে।’ অতিবর্ষণ, বাঁধ বিপর্যয়, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং কখনো কখনো মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় মূলত এর কারণ। তবে এসব প্রাণহানি কেবল বন্যার পানিতে ডুবে হয় না, বন্যা-পরবর্তী অনাহার, দুর্ভিক্ষ এবং রোগেও হয়...

ভয়ংকর বন্যার ইতিহাস

পৃথিবীতে অন্যতম এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নাম ‘ফ্লাড’ কিংবা ‘বন্যা’। প্রতিবছর এই বন্যা মানবসভ্যতার জন্য বিধ্বংসী কিংবা ক্ষয়ক্ষতির কারণ। পৃথিবীর ইতিহাসে ‘বন্যা’ অসংখ্য প্রাণহানির পাশাপাশি অবকাঠামো এবং সম্পত্তিসহ কোটি কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতির সাক্ষী হয়ে আছে। যদিও বিজ্ঞানীরা বিশ্ববাসীকে বারবারই সতর্ক করে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে এই গ্রহের বাসিন্দারা ঘন ঘন বিধ্বংসী বন্যার দেখা পাবে।’ অতিবর্ষণ, বাঁধ ধ্বংস বা বিপর্যয়, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং কখনো কখনো মনুষ্যসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এটি উল্লেখ্য যে, বন্যার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যেসব মৃত্যু ঘটে তা যে কেবলই পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে ঘটে থাকে, এমনটা নয়। বন্যা-পরবর্তী সময়ে অনাহার, দুর্ভিক্ষ এবং রোগ হলো সর্বাধিক প্রাণহানির কারণ।

 

সিটি ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এর একজন বায়ুমন্ডলীয় এবং জলবায়ু বিজ্ঞানী জং-ইউন চু জানিয়েছেন, ‘আবহাওয়ার পরিবর্তন মূলত বায়ুমন্ডলের বৃষ্টিপাতের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর ঘটনার পৌনঃপুনিকতা সৃষ্টি, তীব্রতা বৃদ্ধি এবং সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন হয়।’ বন্যার এমন বাস্তবতায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারকে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রথম সারিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে সংঘাতপূর্ণ রাষ্ট্র এবং দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর সংখ্যাই বেশি। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, বন্যার মতো আবহাওয়া বিপর্যয়ের ঘটনা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। ফলে জলবায়ু সংকট ত্বরান্বিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়মিত দুর্যোগ হয়ে উঠতে পারে। যা মোটেও কাম্য নয়। আর সর্বশেষ ফলাফল হিসেবে মানবসভ্যতার ভোগান্তির পাশাপাশি এই দুর্যোগ সরকারগুলোকে প্রস্তুতির জন্য চাপ বাড়ায়।

 

সাধারণত ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-প্রকৃতি এবং আবহাওয়া বা জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশে নিয়মিত বন্যা হয়। তবে বছরের অন্য মৌসুমের তুলনায় বর্ষায় প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ বেশি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, শীতকালে বায়ু উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয় এবং বর্ষাকালে বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সূর্য দক্ষিণ দিকে সরে যেতে থাকে এবং নভেম্বর থেকে হিমালয়ের শুষ্ক ও ঠান্ডা বাতাস দক্ষিণের দিকে প্রবাহিত হয়, যাকে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুও বলা হয়ে থাকে। তেমনি বর্ষা ঋতুতে অর্থাৎ মে মাসের শেষ দিকে মৌসুমি বায়ু দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তরের দিকে প্রবাহিত হয়। ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রচুর জলীয়বাষ্প নিয়ে হিমালয় পর্বতমালার দিকে প্রবাহিত হয়। এই দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুপ্রবাহের কারণে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এ দেশে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের ৭০-৮০ শতাংশ বর্ষাকালে হয়।

 

মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে নদনদীর পানি সমতল (উচ্চতা) বৃদ্ধিজনিত বর্ষাকালীন বন্যায় নদনদীর পানি সমতল ধীরে ধীরে বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়। আকস্মিক বন্যা বাংলাদেশের উত্তরের কিছু এলাকা, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বাংশে সংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে হয়ে থাকে এবং পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়। একই সঙ্গে পানিপ্রবাহের গতিবেগ বেশি হয়, বন্যা হয় স্বল্পমেয়াদি। অপ্রতুল নিষ্কাশন ব্যবস্থা বা নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়ার কারণে মাঝারি বা ভারী বৃষ্টিপাতের দরুন কোনো কোনো এলাকা বন্যাকবলিত হয়। এই প্রকার বন্যাকবলিত এলাকার পানি সমতল খুব ধীরগতিতে হ্রাস পায় এবং বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ঝড়-ঘূর্ণিঝড়-সাইক্লোন ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস এবং জোয়ারের উচ্চতার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় এক বা একাধিক প্রকার বন্যা দেখা দিতে পারে। নদীর পানি যখন নদীর তীর বা বাঁধ উপচে প্লাবনভূমিতে ঢুকে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে, তখন সেই অবস্থাকে বন্যা বলে। পানি যে উচ্চতায় উঠলে এলাকার ফসলি জমির বা ঘরবাড়িসহ রাস্তাঘাট, বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাকে এ-সম্পর্কিত দুর্যোগের বিপৎসীমা হিসেবে ধরা হয়।

 

পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে মোট ৪৭ শতাংশ পানি অসংখ্য নদী বা জলাশয়ের মাধ্যমে কমপক্ষে দুটি দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়। এর ওপর পৃথিবীর ৪০ শতাংশ মানুষ নির্ভর করে। ভূত্বত্ত্ব বিষেজ্ঞদের ভাষ্যমতে,           পৃথিবীর প্রায় ১৫৩ দেশের ৩১০ নদী এই পানি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি (প্রবাহিত) করে নেয়। তন্মধ্যে ৫৪টি নদী ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, যখন একটি নদী একাধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন তাকে ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার নদী বলে। বাংলাদেশের নদীর অববাহিকাগুলো হলো- গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা। এগুলো বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল ও চীনে বিস্তৃত।

 

বাংলাদেশে স্মরণকালের যত বিধ্বংসী বন্যার রেকর্ড

প্রতি বছরই বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলগুলোতে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। তবে বাংলার মানুষ অতীতে বেশ কয়েকবার বন্যার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছিলেন। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার তালিকা দেখলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিধ্বংসী বন্যা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭, ২০২২ সালে। অর্থাৎ দেখা যায়, ২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি ১০ বছর পর বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭৪, ১৯৮৯, ১৯৯৩ বন্যা হয়েছিল। তবে বাংলায় বন্যা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায় ১৭৮১ সাল থেকে। এরপর ১৭৮৬, ১৭৯৪, ১৮২২, ১৮২৫, ১৮৩৮, ১৮৫৩, ১৮৬৪, ১৮৬৫, ১৮৬৭, ১৮৬৯ সালেও বন্যা হয়েছে বাংলায়। বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৮ ও ২০২২ সালে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক বন্যা হয়। সর্বশেষ এ বছর (২০২৪ সালে) ভারত ডম্বুর বাঁধ খুলে দিলে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে অন্তত ১১টি জেলা প্লাবিত হয়।

১৯৬৬ সালের বন্যা : ১৯৬৬ সালের ৮ জুন ঢাকার অন্যতম প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেখা দেয়। এ বছর সিলেট জেলাতেও বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়। বন্যা ছাড়াও ১২ জুন সকালে এক প্রচন্ড ঝড়ে জেলার পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে। এতে প্রায় ২৫ শতাংশ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ৩৯ ব্যক্তি ও ১০ হাজার গবাদি পশু মারা যায় এবং প্রায় ১২ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর ৫২ ঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টির ফলে ঢাকা শহর প্রায় ১২ ঘণ্টা ১.৮৩ মিটার পানির তলে নিমজ্জিত ছিল।

১৯৮৮ সালের বন্যা : এটি বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায় এবং স্থানভেদে এই বন্যাটি ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। যার মূল কারণ ছিল সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে (মাত্র তিন দিনে) দেশের তিনটি প্রধান নদীর পানিপ্রবাহ একই সময় ঘটায়।

১৯৯৮ সালের বন্যা : ঠিক ১০ বছর পর ৮৮-এর বন্যার স্মৃতি ফিরিয়ে এসেছিল। ১৯৯৮-এর বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত আরেকটি ভয়ংকর বন্যা। দুই মাসের অধিককালজুড়ে সংঘটিত এ বন্যায় দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যায়। প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল।

২০১৭ সালের বন্যা : অঞ্চলভেদে ২০১৭ সালের বন্যার ভয়াবহতা ছিল ব্যাপক। বিশেষত রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। ফলে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যার পানির স্রোতে ভেঙে যায় সড়ক, মহাসড়ক, বেড়িবাঁধ ও রেললাইন।

 

পৃথিবীর বুকে নজিরবিহীন বন্যা বা প্লাবনের রেকর্ড

প্রাকৃতিকভাবে ‘বন্যা’ পৃথিবীর অন্যতম এক শক্তিশালী বিপর্যয়। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় বন্যাকে আশীর্বাদ হিসেবে মনে করা হলেও ‘বন্যা’ মানব ইতিহাসে অসংখ্য সর্বনাশা ঘটনাপ্রবাহের নজির স্থাপন করেছে।  বন্যাপ্রবণ অঞ্চলগুলো বারবারই অগণিত প্রাণহানি, অবকাঠামো এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বা ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে আছে

নুহ (আ.)-এর মহাপ্লাবন

[ খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ বছর ]

পৃথিবীর প্রথম বন্যা হলো হজরত নুহ (আ.)-এর সময়ে মহাপ্লাবন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা ছিল এটি। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুসারে, নুহ (আ.) সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর আদেশে বিশাল এক নৌকা নির্মাণ করেন। প্রত্যেক প্রাণিকুল একজোড়া করে এবং তার সময়ের ইমানদার অর্থাৎ যারা আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছিল তাদের নিয়ে তিনি নৌকায় আরোহণ করেন। তারপর বাকিদের ওপর আল্লাহ মহাপ্লাবন সৃষ্টি করেন। বন্যার পানি পাহাড় তলিয়ে দেয়। নৌকার আরোহীরা ছাড়া মানুষসহ সব প্রাণী এই বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়।

নর্থ সি বন্যা, নেদারল্যান্ডস

[ সময় : ১২১২ সাল ]

নেদারল্যান্ডসের বন্যা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বন্যাগুলোর মধ্যে একটি। এই ভয়াবহ বন্যাটি ১২১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে শুরু হয়। যা ছয় মাসেরও বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল। যদিও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে তা গোটা নেদারল্যান্ডসকে গ্রাস করে ফেলে। সে সময় প্রায় ৬০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে বলে দাবি করা হয়। লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যেতে বাধ্য হয়। এই বন্যা অবকাঠামো এবং সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি করে। এই মহাদুর্যোগের পর নেদারল্যান্ডসবাসীর ঘুরে দাঁড়াতে পরবর্তী দুই বছর সময় লাগে।

 

দক্ষিণ এশিয়ার বন্যা

[ সময় : ২০০৭ সাল ]

২০০৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।  যার শুরুটা হয় নেপালে। ভারী বর্ষণে পানি বাড়তে শুরু করে নদীগুলোয়। পরবর্তীতে বন্যাটি ভুটান, ভারত, পাকিস্তানসহ বাংলাদেশেও বিস্তৃত হয়। জুনের তিন তারিখে শুরু হওয়া এ বন্যা শেষ হয় আগস্টের ১৫ তারিখে। এই দীর্ঘ সময়ে বন্যায় ডুবে যায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও এ বন্যায় মারত্মক ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব কটি জেলা এ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল। বন্যায় বাংলাদেশেই প্রায় ২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। বন্যাটি খুব বেশি জায়গায় বিস্তৃত হওয়ার কারণে সারা দেশেই খাদ্য এবং পানীয়র অভাব দেখা দেয়।

 

বাঙ্কিয়াও বাঁধ বিপর্যয়, চীন

[ সময় : ১৯৭৫ সাল ]

১৯৭৫ সালের ৮ আগস্ট প্রলয়ঙ্করী এক টাইফুন আঘাত হানে চীনে। যার নাম নিনা। ফলে রু নদীর ওপর নির্মিত বাঙ্কিয়াও বাঁধ ভেঙে যায়। প্রাথমিকভাবে এই বিধ্বংসী বন্যায় প্রায় ৮৬ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। বন্যা-পরবর্তী অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অনাহার এবং রোগের কারণে আরও প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ মারা যায়। টাইফুন নিনার আঘাতে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় এক বছরের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। অতিবৃষ্টি আবহাওয়ার পূর্বাভাসকেও ব্যর্থ করে। বাঙ্কিয়া বাঁধ ভেঙে পড়ায় আশপাশের ছোট ছোট বাঁধও ধ্বংস হয়ে যায়।

 

এসটি লুসিয়া বন্যা, জার্মানি

[ সময় : ১২৮৭ সাল ]

এই বন্যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এসটি লুসিয়া। ১২৮৭ সালের ডিসেম্বরে এসটি লুসিয়া উত্তর জার্মানিতে আঘাত করে। জোয়ারের পানির সঙ্গে প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়া সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেয়। এতে প্রায় ৭০ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নেদারল্যান্ডসের ভয়াবহ সেই বন্যার পর এটি ছিল প্রলয়ঙ্করী এক প্লাবন। মূলত সমুদ্র           উথলিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহের মধ্যদিয়ে বন্যা শুরু হয়। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার কারণে অবস্থার        আকস্মিক অবনতি ঘটে। ১২৮৮ সালে এই বন্যার পানি নামতে শুরু করে। এই প্লাবনটি দীর্ঘস্থায়ী না হলেও এর ক্ষয়ক্ষতি ছিল মারাত্মক।

 

রেড রিভার ডেলটা, ভিয়েতনাম

[ সময় : ১৯৭১ সাল ]

এটি ১৯৭১ সালের আগস্টের ১ তারিখে শুরু হয়। এ বন্যায় প্রায় ১ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। হঠাৎ এমন একটি ঘটনা পৃথিবীবাসীকে হতবাক করে দেয়। বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চরম দুর্দশায় কাটে ভিয়েতনামবাসীর জীবন। এই বন্যার সময়ই ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় দুর্দশাও পৌঁছায় চরমে। হানুই শহরে প্রতিদিন ভারী বৃষ্টিপাত হয়। এই শক্তিশালী বন্যায় ভিয়েতনামের প্রায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যা শেষ হলে নদীতে মজবুত বন্যানিরোধ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। যখন যুদ্ধও শেষ হলো তখন তারা  দেশ উন্নত করার দিকে মনোনিবেশ করে।

 

ইয়াংটাজ রিভার ফ্লাড, চীন

[ সময় : ১৯১১ সাল ]

ইয়াংটাজ এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ নদী। এটি তিব্বতের গরুসিয়ার থেকে শুরু হয়ে ইস্টার্ন চীনের দিকে বয়ে গেছে। চীনে ফসলি খেতে সেচের অন্যতম প্রধান নদী এটি। এ ছাড়া নিরাপদ যোগাযোগের জন্য এই নদী ব্যবহার করা হয়। নদীটির মধ্যে যথেষ্ট শক্তিশালী আড়াআড়িভাবে তৈরি করা তিনটি বাঁধ। এটি দেওয়া হয়েছিল চীনের মৌসুমি বন্যার তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে। ১৯১১ সালে পানি এসে নদীর দুই পাড় ভাসিয়ে দেয়। এই বিশাল বন্যায় প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা যায়। প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার বাড়ি ভেঙে পড়ে। বন্যাটি চীনে বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করে।

 

এসটি ফিলিক্স, নেদারল্যান্ডস

[ সময় : ১৫৩০ সাল ]

এই বন্যাটি ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের ৫ তারিখে শুরু হয়। এটি প্রথমে নেদারল্যান্ডসে শুরু হলেও পরে ফ্লেন্ডার্স ও জিল্যান্ডসহ প্রায় ১৮টি শহর তলিয়ে দেয়। এই বন্যার ফলে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। এতে প্রচুর পরিমাণে গৃহপালিত পশুপাখি ও গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি হয়। পুরো নেদারল্যান্ডসই তখন বন্যাকবলিত হয়ে যায়। রাস্তাঘাটের কোনো চিহ্ন ছিল না। প্রচুর পরিমাণে ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে। সারা দেশেই তখন বন্যা সতর্কতার ঘোষণা দেওয়া হয় এবং নেদারল্যান্ডসই একমাত্র দেশ যার পুরো দেশই একবারে দুর্যোগপূর্ণ ঘোষণা করা হয়।

 

ইয়েলো নদীর বন্যা, চীন

[ সময় : ১৯৩৮ সাল ]

১৯৩৮ সালে চীনের ইয়েলো নদীর বন্যায় আনুমানিক ৮ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়। দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধে চীনা জাতীয়তাবাদী সরকার কৃত্রিমভাবে ভয়াবহ এই বন্যার সৃষ্টি করে; যা নিজেদের মর্মান্তিক পরিণতি বয়ে আনে। জাপানি বাহিনী অগ্রসর হচ্ছিল এবং চীনা সরকারকে তাদের বাধা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তাই চীনারা বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে অবাধে পানি প্রবাহিত করার অনুমতি দিয়ে ইয়েলো নদীর বাঁধগুলো ধ্বংস করে দেয়। দুর্ভাগ্যবশত এই বন্যার শিকার হয় চীনা নাগরিক। ১৯৪৫ সালে জাপান পরাজয় স্বীকার না করা পর্যন্ত চীন সরকার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর