রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪ ০০:০০ টা
কী হবে ভবিষ্যতে?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত : কার কত শক্তি

তানভীর আহমেদ

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত : কার কত শক্তি

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধের সুর এখন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বাজছে। যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে ইরান ও ইসরায়েল। দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য আর বিবৃতি বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ আসন্ন। বিশ্লেষকদের ভাষ্য, ইরান ও ইসরায়েলের এই যুদ্ধের আবহে পেছন থেকে কল নাড়ছে  যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা। ফলে এই যুদ্ধ বিশ্বের আসন্ন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম- ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ হয়ে উঠতে পারে

আন্তর্জাতিক এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ইরান এবং ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি রয়েছে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (ঈঝওঝ)-এর নতুন বিশ্লেষণ অনুসারে, সম্প্রতি ভৌগোলিক অবস্থানভেদে সহিংসতার মাত্রা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিককালে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাতের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত হামলার পরিমাণ সপ্তাহে গড়ে ৪.৫ গুণ বেড়েছে। উপরন্তু হামলাগুলো অনেক বড় ভৌগোলিক অঞ্চলকে লক্ষ্য করে করা হচ্ছে। সম্প্রতি সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহর আক্রমণ আন্তর্জাতিক সীমারেখা (ব্লু লাইন) থেকে ২৭-২৮ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি অশনিসংকেত। ভৌগোলিকভাবে এই যুদ্ধের পরিধি বাড়তে পারে। অর্থাৎ লেবানন এবং ইসরায়েলের পাশাপাশি সম্ভাব্য ইরান, সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেনে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে আশঙ্কাও অনেকাংশে সত্যি হয়েছে। বছরব্যাপী লুকোচুরির পর ১ অক্টোবর সন্ধ্যায় ইরান ইসরায়েলে প্রায় ১৮০টি ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা চালিয়েছে। ফলশ্রুতিতে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ বলছে, বিশ্বব্যাপী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় দ্বারপ্রান্তে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনি এক প্রচারণায় এমন আশঙ্কা করেছেন। তবে প্রশ্ন হলো- আসলেই কি এটা হতে পারে? আমরা কি নিউক্লিয়ার যুদ্ধের কবলে পড়তে যাচ্ছি? এটাও সত্য যে, ইসরায়েল ইরানের হামলার শক্ত জবাব দেবে। এদিকে ইরানও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, যদি ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালায় তাহলে ইরান পরবর্তীতে আরও বড় হামলা চালাবে। যা ইসরায়েলের জন্য ধ্বংসাত্মক হবে। এবারের হামলা শুধু সতর্কতা ছিল, নির্দিষ্ট স্থান লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।

এক বছর ধরে বিশ্ববাসীকে একটি ভয় তাড়া করে ফিরছে, মধ্যপ্রাচ্যে কোনো আঞ্চলিক সংঘাত না শুরু হয়ে যায়! কেননা, এর ভয়াবহতা ব্যাপক হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- সেই ভয় এখন প্রায় সময়ের অপেক্ষা। ইতিহাসে ইরান ও ইসরায়েল প্রথমবারের মতো যুদ্ধের ময়দানে একজন আরেকজনের সামনে দাঁড়িয়ে। বরাবরের মতোই বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো দুইপক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। কূটনৈতিক সমঝোতার কথা বলে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জি-৭ এর দেশগুলো জানিয়েছে, ‘ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার জন্য পাল্টা হামলার অধিকার রয়েছে’। ইরানের হামলার নিন্দা করতে গিয়ে আমেরিকা ইসরায়েলের জবাবের সমর্থন ঠিকই দেয়। পাশাপাশি ইরানের তেল উৎপাদন এবং নিউক্লিয়ার স্থাপনায় হামলাকে সমর্থন করবে না বলে জানায়। গেল এক বছর যে যুদ্ধ ইসরায়েল ও ইরান সমর্থিত যেমন হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুথিদের সঙ্গে লড়ছে; এখন সেখানে খোদ ইরান উপস্থিত। যা সত্যিই সমগ্র বিশ্বের জন্য আতঙ্কের। কেননা এর পরিণতি গোটা বিশ্বকে ভুগতে হবে। ইরান কেন ইসরায়েলের ওপর হামলা চালিয়েছে? ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্কের এই অবনতির কারণ কী? কেন মধ্যপ্রাচ্যের দুই শক্তিশালী দেশ যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি? এ জন্য মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েলের অতীতের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত। এই দুই দেশের ইতিহাস শুরু হয় ১৯৪৭ সালে। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনের ভূখন্ডে ইসরায়েল নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে ইরানের শাসক হিসেবে ছিলেন পশ্চিমাদের সমর্থিত তৎকালীন রাজা শাহ মোহাম্মদ রেজা। ইরানে তখন তার সরকার রাজত্ব করছিল। অর্থনৈতিকভাবে সে সময় দুই দেশই একে অন্যের সহযোগী ছিল। কিন্তু ইরান কখনোই ইসরায়েলকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে সমর্থন দেয়নি। যা ছিল কেবলই একটি কূটনৈতিক সম্পর্ক- তন্মধ্যে ছিল গোয়েন্দা তৎপরতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ইরান-ইসরায়েলের বাণিজ্য (ক্রুড অয়েল); এমনকি দুই দেশের সামরিক বাহিনীও নিজেদের মধ্যকার সহযোগিতা করত; যা আজকের বিশ্বে চিন্তাই করা যায় না। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব সবকিছু বদলে দেয়। তৎকালীন রাজা শাহ মোহাম্মদ রেজাকে সরিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেন শিয়া ধর্মীয় গুরু আয়াতুল্লাহ খোমেনি। ইরান পরিচিতি পায় ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান হিসেবে। বিপ্লবের পর ইরান ইসরায়েলের কট্টর সমালোচক হয়ে ওঠে। ইরান অন্য সব মুসলিম দেশগুলোর মতো ইসরায়েলকে অবৈধ ইহুদি দখলদার হিসেবে ঘোষণা করে। এখান থেকে শুরু ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্কের বৈরিতা। এ কথা সত্য যে, জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো ইহুদিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। শিয়া সমর্থিত ইরান বরাবরই জানিয়ে আসছে, ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্য এবং ফিলিস্তিনের জন্য হুমকি। এমনকি ইরান বলেছিল, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তাহলে এ কারণেই হবে। যদিও অতীতে দুই দেশের মধ্যকার নানা উৎকণ্ঠা থাকলেও সম্প্রতি তা বিশ্ববাসীর জন্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা কোনো আঞ্চলিক সংঘাত কিংবা বৈশ্বিক সংঘাত হলে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির চাকা থমকে যায়। যে কোনো দেশে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। বেড়ে যায় বেকারত্বের হার। এটা বুঝতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যে দুই দেশে বৈরিতা সব সময়ই ছিল। গোটা বিশ্বই অবগত যে, পশ্চিমারা জেনেশুনে ইসরায়েলকে  ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছে। ইসরায়েলকে চাপে রাখতে ইরান ইসরায়েলের চারপাশে মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম হয় ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুথি। যারা আজও ইসরায়েলি দখলদারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। ইরান এই মিলিশিয়াদের সরাসরি অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে।

১৯৯০ সালে ইরান নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরিতে এগিয়ে যায়। ইরানের ভাষ্য, তাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্র থাকলে আমেরিকা ইরানে হামলার চিন্তাও করবে না। অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের নিউক্লিয়ার শক্তি হুমকি হিসেবে দেখে। কেননা, তাদের ভাষ্য- যদি ইরান নিউক্লিয়ার অস্ত্র পায়, তাহলে ধ্বংস হবে ইসরায়েল। ১৯৯৬ সালে আমেরিকার মাধ্যমে ইসরায়েল নিউক্লিয়ার অস্ত্র হাসিল করে। কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল তার পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার শক্তিশালী করেছে। যদিও দেশটি সরাসরি বিষয়টি স্বীকার করে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশ এই নিউক্লিয়ার অস্ত্র হাসিল করবে, এটা আমেরিকা কখনোই চাইত না। যার অন্যতম উদাহরণ ১৯৮১ সালে ইরাকের নিউক্লিয়ার স্থাপনায় ইসরায়েলের বিমান হামলা। তাদের দাবি ছিল, ইরাক নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরি করছে। যদিও পরবর্তীতে এর কোনো সত্যতা মেলেনি। একই পদ্ধতিতে ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলাও চালিয়েছে। কিন্তু এবার তারা ইরানের নিউক্লিয়ার স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়নি। তারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। ২০০৭ সালে তারা একের পর এক গুপ্ত হামলায় ইরানের সাতজন নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীকে রহস্যজনকভাবে হত্যা করে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছিল মহসিন ফাখরিজাদেহর হত্যা। যিনি ছিলেন ইরানের প্রধান নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী। এসব হত্যার পেছনে ছিল কখনো গাড়িবোমা অথবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে রিমোট কন্ট্রোল পরিচালিত মেশিনগানের নির্ভুল নিশানা। বলা হয়, এর পেছনে ইসরায়েলের মোসাদের হাত রয়েছে। এখানেই থেমে থাকেনি ইসরায়েল। ২০১০ সালে সাইবার অ্যাটাক চালায়। ফলে ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম দুই বছর পিছিয়ে পড়ে। ইসরায়েলের মোসাদ এতটাই দুর্ধর্ষ যে, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থায়ও এদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ফিলিস্তিনিদের ওপর অত্যাচার, গাজায় গণহত্যা, সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে হামলা এবং সবশেষ লেবাননে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। যার মধ্যে সিরিয়া ও লেবাননের হামলায় ইরানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাসহ হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হন। এমনকি মোসাদ ইরানের ভিতরেই হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকেও হত্যা করে। কথিত আছে, ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মোসাদের হাত থাকতে পারে। ইরানের দাবি, ইসরায়েল তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। তারা ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করেছে। এর জবাবে ছয় মাস আগেও স্থানীয় সময় ভোর রাতে ইরান ইসরায়েলের ওপর তিন শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল।

 

ভৌগোলিক অবস্থান

ইরানের আয়তন ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ১৯৫ বর্গকিলোমিটার এবং ইসরায়েলের আয়তন ২১ হাজার ৯৩৭ বর্গকিলোমিটার। ইরানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ইরাক, তুরস্ক, আরমেনিয়া, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের। ইসরায়েলের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে মিসর, জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননের। বিশ্বে ১০৮তম অবস্থানে থাকা ইরানের অন্য দেশের সঙ্গে সীমানার পরিমাণ ৫ হাজার ৮৯৪ কিলোমিটার। ইসরায়েলের আছে ১ হাজার ৬৮ কিলোমিটার।

 

প্রাকৃতিক সম্পদ

ইরান প্রতিদিন উত্তোলন করে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল তেল। প্রুভেন অয়েল রিজার্ভের ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। তাদের প্রুভেন রিজার্ভ ২১ হাজার কোটি ব্যারেল। আর ইসরায়েল ১ কোটি ২৭ লাখ ব্যারেল প্রুভেন রিজার্ভ নিয়ে বিশ্বে ৭১তম অবস্থানে আছে। ইসরায়েলের কোনো কয়লা খনি নেই।  ইরান কয়লা উত্তোলনের দিক থেকে বিশ্বে ৪৩তম। প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনে বিশ্বে ইরানের অবস্থান তৃতীয়, যেখানে ইসরায়েলের অবস্থান ৪০তম।

 

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ : কার পক্ষে কে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জার্মানির মতো দেশগুলো ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই যুদ্ধে তাদের সাহায্যও করছে। ইসরায়েলে সাম্প্রতিক হামলার পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির  বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) সোচ্চার হয়েছেন নেদারল্যান্ডসের রাজনীতিবিদও।

সৌদি আরব : প্রায় চার মাস আগে রাফাহ শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার পর সৌদি আরব বলেছিল, ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব মেনে নিতে হবে ইসরায়েলকে। হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর গত সপ্তাহে সুন্নি নেতৃত্বাধীন সৌদি আরব একটা বিবৃতি জারি করে জানিয়েছিল, লেবাননে যা ঘটছে তা গভীর উদ্বেগের বিষয়। জিসিসির পক্ষ থেকে সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি জসিম বিন আল-বুদাইবি লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাত : হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যু এবং তার পরের পরিস্থিতি নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত একেবারে নিশ্চুপ। ইউএইর পাশাপাশি কিন্তু কাতার এবং বাহরাইনও এই প্রসঙ্গে নীরব। তবে বাহরাইন, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত- এই ছয়টি উপসাগরীয় রাষ্ট্রের সমন্বয়ে তৈরি ‘গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল’ বা জিসিসি কিন্তু লেবাননের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে একটা বিবৃতি জারি করেছে। 

কাতার : মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের বিষয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কাতার এই সংঘর্ষ বন্ধের পক্ষে। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সে দেশের কোনো রকম আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই।

মিসর : হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেছিলেন, লেবাননের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করার বিরুদ্ধে মিসর। ইরানের প্রক্সি ও নীতিকে কেন্দ্র করে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান মিসরের। তবে ইরানের সঙ্গে ‘অনানুষ্ঠানিক’ আলাপ চালাতে দেখা যায় তাদের। মিসরের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, মিসর যে কোনো মূল্যে ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়।

জর্ডান : ইরানের ড্রোন ও মিসাইল থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য আমেরিকা ও ব্রিটেনের পাশাপাশি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে দেখা যায় জর্ডানকে।   যদিও এক বিবৃতিতে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, তারা নিজের দেশকে রক্ষা করার ড্রোন ভূপাতিত করেছে, ইসরায়েলকে সাহায্য করার জন্য নয়।

তুরস্ক : তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে ১৯৪৯ সাল থেকে। তবে ২০০২ সাল থেকে তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কের উত্থান-পতন দেখা গেছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তুরস্ক ইসরায়েলের বিরোধিতা করে তাদের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখিয়ে এসেছে।

 

বিশ্বের ১৪৫টি দেশের তালিকায় সামরিক শক্তিতে অবস্থান

 

ইসরায়েলের সুরক্ষাকবচ আয়রন ডোম

ইসরায়েলের রয়েছে কয়েক স্তরের আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তন্মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত আয়রন ডোম। এটি রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমের তৈরি। যা নির্মাণে সহায়তা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের রিপোর্ট অনুযায়ী, আয়রন ডোম হলো অ্যান্টি-রকেট, অ্যান্টি-মর্টার এবং অ্যান্টি আর্টিলারি সিস্টেম। এটি ২.৫ থেকে ৪৩ মাইল বা ৪ থেকে ৭০ কিমি দূর থেকে রকেট বা মিসাইল আটকে দিতে পারে। তারপর কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে রকেটের পথ সম্পর্কে তথ্য দেয়। এটি মূলত ব্যাটারির সিরিজ; যা রাডারের মাধ্যমে শর্ট-রেঞ্জের রকেট শনাক্ত করে আটকে দেয়। প্রতিটি ব্যাটারিতে তিনটি বা চারটি লঞ্চার, ২০টি ক্ষেপণাস্ত্র এবং একটি রাডার থাকে। ২০২১ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল দেশজুড়ে অন্তত ১০টি আয়রন ডোম ব্যাটারি মোতায়েন করেছে। প্রতিটি ব্যাটারি ৬০ বর্গমাইল এলাকাকে রক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এর কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১১ সালে এগুলো প্রথম মোতায়েন করা হয়।

 

ইসরায়েলের আছে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা দল

ইসরায়েলের মোসাদকে বিশ্বের অন্যতম দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনী ধরা হয়। বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত তাদের নেটওয়ার্ক। আছে ইরানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে বিভিন্ন সময় সফল গুপ্তচরবৃত্তি ও হামলার ইতিহাস। ইরানকে ঠেকাতে গত দুই দশকে ইরানের সাত পরমাণু বিজ্ঞানীকেও গুপ্তহত্যা করেছে। অভিযোগ রয়েছে, এই সাতজন পরমাণু বিজ্ঞানী ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গুপ্তহত্যার শিকার। এর পেছনে রয়েছে কখনো গাড়িবোমা অথবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে রিমোট কন্ট্রোল পরিচালিত মেশিনগানের নির্ভুল নিশানা। মোসাদ কর্তৃক ইরানি বিজ্ঞানী হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ২০২০ সালের নভেম্বরে। ইরানের সবচেয়ে মেধাবী ও চৌকশ পরমাণু বিজ্ঞানী মহসিন ফাখরিজাদেহকে তেহরানের রাস্তায় রিমোট কন্ট্রোল মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

 

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডার

ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আধুনিকায়নে ইরানের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে বরাবরই শঙ্কিত ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। গত এক দশকে ইরানের মিত্রদেশগুলো আধুনিক যুদ্ধবিমান ও বিভিন্ন অস্ত্রের প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে বলেও পশ্চিমা মিডিয়াগুলো খবর প্রচার করেছে। সব মিলিয়ে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সামরিক শক্তিধর হয়ে উঠেছে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর চেয়ে ইরানের কাছে রয়েছে সবচেয়ে বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন। দেশটির এমন ড্রোন আছে, যেগুলো ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত যেতে পারে। এসব ড্রোনের বিশেষত্ব হলো- এগুলো খুবই নিচ দিয়ে উড়তে পারে। ফলে ড্রোনগুলো রাডারে ধরা পড়ে না। এ ছাড়া ইরানের রয়েছে ক্রুজ ও জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন ইসরায়েল। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডারকে মধ্যপ্রাচ্যের বড় ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি বলে উল্লেখ করেছে। যার মধ্যে আছে খোররামশহর-৪ (খাইবার), হাজি কাশেম, খাইবার শেকান, সিজ্জিল, ফাত্তাহ ১ ও ২, কদর, এমাদ ইত্যাদি ক্ষেপণাস্ত্র।

 

ইরানের তুরুপের তাস হরমুজ প্রণালি

সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নয়, ইরানের তুরুপের তাস হরমুজ প্রণালি। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে হরমুজ প্রণালিতে ইরানের আধিপত্য রয়েছে। ইরান চাইলে যে কোনো সময় বন্ধ করে দিতে পারে এই ট্রানজিট। পশ্চিমা বিশ্ব এ নিয়ে সব সময় উদ্বিগ্ন। হরমুজ প্রণালির সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ থেকে ইরান এবং ওমানের দূরত্ব মাত্র ২১ মাইল। একদিকে পারস্য উপসাগর, অন্যদিকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগর। এই প্রণালিই এখানে সংযোগ স্থাপন করেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বে সমুদ্রপথে তেল সরবরাহের একমাত্র পথ এটি। বিশ্বে প্রতিদিন ব্যবহৃত তেলের এক-পঞ্চমাংশ এই প্রণালি দিয়েই আনা-নেওয়া করা হয়। প্রতিদিন চলাচল করে অন্তত ৮৫টি তেলবাহী জাহাজ। শুধু তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ আট দেশ ইরান, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের সঙ্গে পুরো বিশ্বের সমুদ্রপথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই প্রণালি। বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রণালি বন্ধ করে দিলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে।

 

 

 

সর্বশেষ খবর