যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস হোগল নাম বদলে হয়েছেন মো. আইয়ুব আলী। বিয়ে করেছেন রহিমা খাতুনকে। থাকছেন যশোরের প্রত্যন্ত গ্রাম মেহেরপুরে। গ্রামের মানুষ তাকে ‘হোগল ভাই’ বলেই ডাকেন। বাজারে যান, মাঠে কৃষিকাজ করেন। বাড়িতে ১৩টি গরু, ২৩টি ছাগল আর দেশি জাতের ২০০টি মুরগি আছে। সেগুলোর লালনপালন নিজ হাতেই করেন। স্বপ্ন দুজনের ভালোবাসার সাক্ষী হিসেবে গ্রামের মানুষের জন্য বানাবেন হাসপাতাল...
ভিন দেশের নাগরিক, ভিন্ন তার ভাষা, ভিন্ন তার সংস্কৃতি। তবু ভালোবাসা যেসব সীমানা পেরিয়ে যায়, তারই প্রমাণ এই দম্পতি। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস হোগল ও বাংলাদেশের যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার প্রত্যন্ত মেহেরপুর গ্রামের রহিমা খাতুন। গল্পের শুরু ২০০৯ সালের কোনো এক সন্ধ্যায় ভারতের মুম্বাই শহরে। ব্যস্ততম এক সড়কে মুম্বাই সিনেমার মতোই দুজনের চোখাচোখি হয়। তারপর ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কথা। দেখা হয় আরেক দিন। চলতে থাকে কথা। ছয় মাসের মাথায় বিয়ে, দেনমোহর ৭৮৬ ডলার। তিন বছর পর দুজনে মিলে চীনে পাঁচ বছর কাটিয়ে সোজা চলে আসেন যশোরের মেহেরপুর গ্রামে। রহিমার পৈতৃক ভিটাকেই বাকি জীবনের ঠিকানা বানিয়ে নেন। ক্রিস হোগল নাম বদলে হয়েছেন মো. আইয়ুব আলী। যদিও গ্রামের মানুষ তাকে ‘হোগল ভাই’ বলেই ডাকেন। বাজারে যান, মাঠে কৃষিকাজ করেন। বাড়িতে ১৩টি গরু, ২৩টি ছাগল আর দেশি জাতের ২০০টি মুরগি আছে। সেগুলোর লালনপালন নিজ হাতেই করেন। পাশাপাশি দুজনের ভালোবাসার সাক্ষী হিসেবে গ্রামের মানুষের জন্য বানাবেন একটি হাসপাতাল। ইতোমধ্যে ২০ তলা ফাউন্ডেশনে ভবন নির্মাণকাজ শুরু করেছেন, চার তলা পর্যন্ত কাজ হয়েছে। হাসপাতালের নাম ঠিক করেছেন ‘রহিমা-হোগল উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন হসপিটাল’। ‘গ্রামের নারী-শিশুদের চিকিৎসা নিতে শহরে যেতে অনেক কষ্ট হয়। তাই ভাবলাম, একটা হাসপাতাল গড়ে তুলি। ইচ্ছে, এই গ্রামেই মানুষ যেন উন্নত চিকিৎসা পায়, চিকিৎসার জন্য শহরে যেতে না হয়’, বলেন হোগল।
শুরুতে এই ভবনে বসবাসের পরিকল্পনা ছিল তাদের। রহিমা খাতুন জানালেন, ‘বাড়ির কাজ শুরু করেছিলাম নিজেদের থাকার জন্য। পরে ভাবলাম, মানুষের উপকার হবে। তাই হাসপাতাল বানানোর সিদ্ধান্ত নিই।’ নিজেদের ওই বাড়িটি হাসপাতাল বানিয়ে যশোর শহরে গিয়ে বসবাস করার যশোর শহরের মুড়লীতে একটি জমিও কিনেন। বাড়ির পাশে বাঁশবাড়িয়া বাজারে কিনেন ১০ শতক জমি। এখন কিছু অর্থসংকটের কারণে হাসপাতাল নির্মাণকাজ বন্ধ আছে। এখন নিজের পেনশনের টাকায় সংসার চলছে। হোগল জানান, চায়না পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে তার কিছু শেয়ার আছে। সেগুলো বেচে হাসপাতাল নির্মাণকাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। রহিমা বলেন, তার আগের স্বামীর তিন সন্তান তাদের সঙ্গে থাকেন। সবাই মিলে সুখেই আছেন তারা। ‘হোগল উচ্চশিক্ষিত হলেও তার মধ্যে কোনো অহংকার নেই। কোনো কাজেই অস্বস্তিবোধ করেন না। আমাদের জীবনযাত্রা, ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে পুরোপুরি মানিয়ে নিয়েছেন’, বলেন রহিমা। ক্রিস হোগলের বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। সেখানে তার স্ত্রী ও দুই ছেলে আছে। তাদের সঙ্গে ফোনে মাঝেমধ্যে কথা বলেন হোগল। ভারতে অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ন্যাচারাল রিসোর্সেস লিমিটেড কোম্পানিতে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করতেন। সেই সুবাদেই মুম্বাই শহরে রহিমার সঙ্গে দেখা তার। আর নিজের মুম্বাই যাওয়া প্রসঙ্গে রহিমা বলেন, ‘শৈশবে বাবা আবুল খাঁ ও মা নেছারুন নেছার হাত ধরে ভারতে যাই। পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন, বাবা শ্রমিকের কাজ করতেন। বারাসাতে বস্তিতে থাকতাম। ১৪ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। তিনটি সন্তানও হয়। কিন্তু অভাবের সংসার ফেলে স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পরে জীবিকার সন্ধানে মুম্বাই গিয়ে আত্মীয়ের বাসায় উঠি। সেখানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতাম। এর মধ্যে বাবা-মা বারাসাত থেকে যশোরে বাড়িতে ফিরে যান। আর ২০০৯ সালের কোনো এক সন্ধ্যায় মুম্বাই শহরের ব্যস্ত রাস্তায় দেখা হয় হোগলের সঙ্গে। যশোরের প্রত্যন্ত নিভৃত গ্রাম মেহেরপুরের মাটিতে জীবনের শান্তি খুঁজে পেয়েছেন হোগল আর রহিমা। একদিন তাদের ভালোবাসার স্মারক হয়ে উঠবে ‘রহিমা-হোগল উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন হসপিটাল’। নিঃসন্দেহে তাদের প্রেম, স্বপ্ন আর দায়বদ্ধতার গল্প বহুদিন স্মরণে রাখবে মেহেরপুর ও আশপাশের গ্রামের মানুষ।