২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ১১:৪৬

টেঁটাযুদ্ধে এলাকাছাড়া ৫০ হাজার ভোটারের ভোট অনিশ্চিত

সঞ্জিত সাহা, নরসিংদী:

টেঁটাযুদ্ধে এলাকাছাড়া ৫০ হাজার ভোটারের ভোট অনিশ্চিত

প্রতিপক্ষের হামলায় বিধ্বস্ত বাড়ি

নির্বাচনের আমেজ নেই নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেঘনা নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলে। কারণ টেঁটাযুদ্ধের ঘটনায় প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে ও মামলার আসামি হয়ে চরাঞ্চলের জনসংখ্যার অর্ধেকই এখন এলাকাছাড়া। বিএনপির দাবি যার সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাদের ভোট প্রদান অনেকটাই অনিশ্চিত। ফলে নাগরিক দায়িত্ব ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে চরাঞ্চলের বিপুল জনসংখ্যার একটি অংশ।

চরাঞ্চলের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি । তবে আওয়ামী লীগ বলছে উভয় পক্ষ চরাঞ্চলে প্রবেশ করলে ফের সংঘাতের ঘটনা ঘটতে পারে। আর প্রশাসন বলছে ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে কেন্দ্রে আসলে তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে।

নিলক্ষ্যা, বাঁশগাড়ী, চরমধূয়া, মির্জারচর, পাড়াতলী, চাঁনপুর, শ্রীনগর এবং চরআড়ালিয়া- নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেঘনা নদী বেষ্টিত এই ৮টি ইউনিয়ন চরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। রায়পুরা উপজেলার ২৪ টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত নরসিংদী-৫ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৯৯ জন। এদের মধ্যে চরাঞ্চলের ৮টি ইউনিয়নের মোট ভোটার এক লাখ ২ হাজার ২৭ জন।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চরাঞ্চলের বাঁশগাড়ি ইউনিয়নে সাবেক প্রয়াত দুই চেয়ারম্যান সিরাজুল হক ও সাহেদ সরকারের সমর্থকদের মধ্যে টেঁটাযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে সিরাজুল হকের সমর্থকরা এলাকায় অবস্থান করলেও এলাকাছাড়া রয়েছে সাহেদ সরকারের সমর্থকরা।

নিলক্ষা ইউনিয়নে সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হক সরকার ও সুমেদ আলীর সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এরই জের ধরে বর্তমানে সুমেদ আলীর সমর্থকরা এলাকা ছাড়া রয়েছে। মির্জাচরে চেয়ারম্যান ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাফর ইকবাল মানিকের সঙ্গে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ফিরোজের ছেলে ফারুকুল ইসলামের বিরোধ রয়েছে। বর্তমানে চেয়ারম্যান মানিকের সমর্থকরা এলাকাছাড়া রয়েছে।

পাড়াতলী ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান মাসুদের সঙ্গে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুজ্জামান তুহুর বিরোধ চলছে। বিষয়টি রাজনৈতিক সমঝোতা হলেও মাসুদের সমর্থকরা এলাকায় টিকতে পারছেনা। চর আড়ালিয়ায় চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান সরকারের সঙ্গে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান সরকারের বিরোধ চলছে। বর্তমানে হাসানের সমর্থকদের শীর্ষ নেতারা এলাকাছাড়া। আর সমর্থকরা রয়েছে কোণঠাসা।

চাঁনপুর ইউনিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল মিয়ার সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল কাদির জিলানীর বিরোধ রয়েছে। জিলানীর সমর্থকরা এলাকায় অবস্থান করলেও কোণঠাসা রয়েছে। চরমধুয়া ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুস সালাম শিকদার ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর আলম ফকিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। দুই পক্ষই এলাকায় অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে। শ্রীনগর ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান চৌধুরী আজানের সঙ্গে সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ মোর্শেদ রাসেলের দ্বন্দ্ব রয়েছে। বর্তমানে উভয় পক্ষ এলাকায় অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে মত বিরোধ চলছে।

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চলে টেঁটাযুদ্ধ অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে চরাঞ্চলের ৮টি ইউনিয়নে টেটাবল্লম ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আধিপত্য বিস্তারের লড়ায় চলে আসছে। ছয়বারের ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল হক দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহতসহ বহুলোক টেটাবল্লম ও গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ফলে এ ইউনিয়নগুলোতে কয়েক হাজার ভোটার বাড়িঘর ছেড়ে পলাতক রয়েছে। প্রতিপক্ষের বিভিন্ন মামলায় আরও কয়েক হাজার ভোটার আসামি হয়ে এখন এলাকাছাড়া। যারা গ্রামে অবস্থান করছে তারাও পেশীশক্তির হাতে জিম্মি। ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হলে নির্বাচনের আমেজ নেই চরাঞ্চলে।

রায়পুরা উপজেলার সদরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত শাখা নদীর উপর নির্মিত সেতু পেরিয়ে এগুলেই মূল মেঘনা নদী। ফেরি গিয়ে বিশাল মেঘনা পাড় হয়ে চরাঞ্চলে প্রবেশ করি। ফেরিঘাট থেকে রায়পুরা-বাঁশগাড়ি সড়কে সামনে এগিয়ে চলা। বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের প্রবেশের আগেই পড়ে পাড়াতলী ইউনিয়নের আড়াকান্দা গ্রাম। সড়কের পাশেই প্রতিপক্ষের হামলায় দুমড়ে মুচড়ে পড়ে রয়েছে হোসেন মিয়ার বাড়ি।
ওই বাড়ির পাশেই কথা হয় ষার্টোদ্ধ বৃদ্ধা আফিয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘৮ মাস আগে বাঁশগাড়ির সিরাজুল হক চেয়ারম্যান মরার পড়ে এই বাড়ির লোক প্যাচে পড়ে। ওই ঘটনার পরই এই বাড়ি ভাইঙ্গা ফেলে। এরপর আর তারা বাড়ি আইতে পারেনাই।’

একই সড়কে সামনে এগুলো বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের চরমেঘনা গ্রামের নুরু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, বরকত উল্লাহর বিধ্বস্ত বাড়ি চোখে পড়ে। বাঁশগাড়ি বাজারে প্রবেশ মুখে তৈরি করা হয়েছে নরসিংদী-০৫ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর তোরণ। বাজারে ঝুলানো হয়েছে পোষ্টার।
বাজার থেকে ভেতরে ঢুকতেই বটতলী গ্রাম। সেখানে গিয়েও অনেক ভাঙ্গাচুড়া বাড়ি-ঘর দেখা যায়। তাদের অনেক বাড়িতেই মানুষ না থাকার চিহ্ন স্পষ্ট। দীর্ঘদিন যাবত মানুষ না থাকায় ঘরের দেয়াল ও মেঝেতে আগাছা জন্মেছে।

বটতলী গ্রামের গৃহবধু রেহেনা বেগম বলেন, ‘গ্রামের লোকজন যে যেখানে গিয়ে বাঁচতে পারে সেখানে গিয়ে বাঁইচ্চা রইছে। তারা বাইগ্গা থাইক্কা রইছে, আইতে পারলেছে ভোট দিতে পারতো। সবারে মিলাইয়্যা দিলেতো ভালই আছিল, সবাই মিইল্লা ভোট দিতে পারতো।’

একই গ্রামের শান্তি মিয়া বলেন, ‘এলাকার মধ্যে অর্ধেক মানুষ আছে আর অর্ধেক নাই। মহিলা পর্যন্ত নাই। তারা সব বাড়ি ছাইর‌্যা গেছে গা। এসব লোকেরা নাই ভোটটা দিব কারা ?’

এই একই চিত্র চরাঞ্চলের বিভিন্ন ইউনিয়নের। টেঁটাযুদ্ধে প্রতিপক্ষের হামলায় বিধ্বস্ত বাড়ি ও সাধারণ মানুষের আর্তনাথ বলছে নির্বাচনে তাদের বঞ্চনার কথা।

বাঁশগাড়ি থেকে পালিয়ে আসা অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে পাশ্ববর্তী নিলক্ষা ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। সেখানে কথা হয় এক পক্ষের নেতৃত্ব দেয়া বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল আহমেদ সুমনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে শুধুমাত্র বাঁশগাড়ির ৪ হাজারের অধিক নেতা-কর্মী এলাকা ছাড়া রয়েছে। আমরা আওয়ামী লীগ করেও আজ ভেসে আসা আওয়ামী লীগের জন্য এলাকা ছাড়া। দলকে ভালবেসেও নির্বাচন করতে না পারা দুঃখজনক। আমরা এই অবস্থার পরিত্রাণ চাই। নির্বাচনে ভোট দিতে চাই।

বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বকুল বলেন, প্রতিপক্ষের হামলা ও মামলার আসামি হয়ে চরাঞ্চলের ৫০ হাজার ভোটার এখন এলাকা ছাড়া এবং পেশিশক্তির হাতে জিম্মি। এত বিপুল সংখ্যাক লোককে নির্বাচনের বাইরে রেখে সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনা। তাই আমি সুষ্ঠ নির্বাচনের স্বার্থে আমরা নির্বাচন কমিশনের নিকট চরাঞ্চলে টেঁটাযুদ্ধে সৃষ্ট বৈরী পরিবেশ স্বাভাবিক করে সকলের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবী জানিয়েছে।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু বলেছেন, চরের মানুষকে বিশ্বাস করা কঠিন। ভোট দিবে এটা কোন সমস্যা নাই। তবে এর সুযোগে ফের সংঘাত হউক এটা কাম্য নয়। একই সঙ্গে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর চরের সংঘাত দূর করে শান্তি ফেরাতে উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন।

এদিকে জেলা রিটানিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বলেছেন, ভোটারদের বাড়ি থেকে আনার দায়িত্ব প্রশাসনের নয়। চরাঞ্চলে ভোট প্রদানে কোন বিধি নিষেধ নেই। ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে কেন্দ্রে আসলে তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হবে।


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর