রবিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রচারণায় এগিয়ে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে বিএনপি

► গ্রামে-গঞ্জে অলি-গলিতে সর্বত্রই নৌকার পোস্টার ► দেখা মেলে না ধানের শীষের পোস্টার-লিফলেট ► ডিজিটাল প্রচারেও নৌকার প্রার্থীরা ► প্রচারে নানামুখী বাধার অভিযোগ বিএনপির

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

প্রচারণায় এগিয়ে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে বিএনপি

নোয়াখালী-৫ আসনে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের

ঢাকাসহ সারা দেশেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের পোস্টারে ছেয়ে গেছে। গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে রাজধানীর সব অলি-গলিতে দেখা মেলে নৌকার সাদাকালো পোস্টার। মহাজোট প্রার্থীদের পোস্টার। কিন্তু কোথাও নেই বিএনপি। রাজধানীতে কোথাও দেখা যায় না ধানের শীষের পোস্টার। এমনকি তৃণমূলেও খুব কম পোস্টার সাঁটাতে পেরেছে বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা ২০-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা। প্রযুক্তিনির্ভর প্রচারণায়ও এগিয়ে আওয়ামী লীগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ সর্বত্রই আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পক্ষে নানা ধরনের প্রচারণা। বিপরীতে বিএনপির ডিজিটাল প্রচারণা খুবই কম। অবশ্য বিএনপির অভিযোগ, ধানের শীষের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণার কিছু সাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এখনো ঠুঁটো জগন্নাথ। কোথাও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারেনি। ধানের শীষের প্রার্থীদের কোথাও পোস্টার পর্যন্ত সাঁটাতে দেওয়া হচ্ছে না। ছাপাখানায় হুমকি দিয়ে আসছে। প্রতিদিন হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। প্রচারণায় হামলা করা হচ্ছে। এভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের উন্নয়নের সুফল মানুষ পাচ্ছে। সে কারণে সারা দেশে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দেশের মানুষ আর আগুনসন্ত্রাসে ফিরে যেতে চায় না। তারা শান্তি চায়, ঐক্য চায়। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত বিগত দিনে লুটপাট, অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে মাঠে নামতে ভয় পাচ্ছে। সে কারণে বিএনপির চেয়ে প্রচারে এগিয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ।’

আওয়ামী লীগ : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকেই জোর নির্বাচনী প্রচারে রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্য ঘরে ঘরে গিয়ে প্রার্থী, দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা ভোট প্রার্থনা করছেন। অন্যদিকে নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন রুপালি জগতের তারকা এবং ব্যবসায়ীরা। ডিজিটাল প্রচারণায়ও এগিয়ে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দলীয় প্রার্থী ছাড়াও নিজ দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের প্রচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে নির্বাচনী এলাকা। গত ১০ বছরের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে এবং চলমান মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রার্থী ও সমর্থক নেতা-কর্মীদের চলছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নৌকায় ভোট চাইছেন খোদ দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য তিনি জেলায় জেলায় ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিন দিনে ১০ জেলায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নৌকায় ভোট চেয়েছেন। গত শুক্রবার রাজধানীর গুলশান ও গতকাল সিলেটে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিয়ে নৌকায় ভোট চান। আজকে রংপুরের দুটি নির্বাচনী জনসভায় অংশ নেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইভাবে আগামীকাল রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে নির্বাচনী জনসভায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এবং তৃণমূলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রচার চলছে জোরেশোরে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পাড়া-মহল্লা, গ্রাম, হাটবাজার ছেয়ে গেছে পোস্টারে। রোজ দুপুরের পর কর্মী-সমর্থকদের নির্বাচনী মিছিলে সরগরম হয়ে উঠছে বিভিন্ন এলাকা। প্রার্থীরা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকছেন গণসংযোগে। সর্বত্র নির্বাচনী আমেজ, আড্ডায়-আলোচনায় একটাই প্রসঙ্গ- ভোট।  পোস্টার, মিছিল, মাইকিং, গণসংযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পথসভাসহ সব ক্ষেত্রেই নৌকার প্রচার চোখে পড়ার মতো। 

আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের প্রার্থীদের প্রত্যেকে ফেসবুক পেজ খুলে প্রচার চালাচ্ছেন। ভোটারদের মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। পাড়ায় পাড়ায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংগঠনিক কার্যালয় গভীর রাত অবধি মুখর থাকছে নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতিতে।

প্রচারে এগিয়ে থাকার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১০ বছরে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় যেভাবে সাফল্য এসেছে, তার কারণে সারা দেশে এবারও নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন নৌকার প্রচার কার্যক্রমে।

বিএনপি : ১০ ডিসেম্বর প্রচারণা শুরু হলেও উৎসবমুখরভাবে মাঠে নামতে পারেনি বিএনপি। সারা দেশেই বিএনপি, ২০ দল এবং ঐক্যফ্রন্টের একই অবস্থা। দেশের অলিগলিতে নৌকার পোস্টার দেখা গেলেও ধানের শীষের পোস্টার খুব কম স্থানেই চোখে পড়ে। প্রচার মিছিল কিংবা মাইকিংও কম। বহু স্থানে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যালয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীর উপস্থিতি কম। কোথাও কোথাও এখনো তালা ঝুলতে দেখা গেছে। আবার অনেক স্থানেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের গণসংযোগে বেশ সক্রিয় দেখা গেছে। যেমন পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কক্সবাজার, বগুড়ার বিভিন্ন আসনসহ বহু স্থানে গণসংযোগে বিএনপি নেতা-কর্মীরাই এগিয়ে।  বিএনপির দফতর শাখা সূত্রে জানা যায়, গতকাল পর্যন্ত ধানের শীষের ১৬ জন প্রার্থী কারাগারে। অর্ধশত আসনে এখনো প্রার্থী জটিলতা চলছে। তফসিল ঘোষণা থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৫ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধানের শীষের তিন সহস্রাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। নতুন করে মামলাও হয়েজে দুই হাজারের ওপরে।  রাজধানীতে গত এক সপ্তাহ প্রচারণাই চালাতে পারেনি ধানের শীষের প্রার্র্থীরা। গোটা রাজধানী ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গেলেও ধানের শীষের পোস্টার খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। ঢাকায় ১৫টি আসনের প্রায় অর্ধেক প্রার্থী একবারের জন্যও মাঠে দেখা যায়নি। তবে তাদের অনুসারীরা বিক্ষিপ্তভাবে প্রচারপত্র বিতরণ করছেন। ধানের শীষের প্রার্থীদের অভিযোগ, গত ১০ দিনে রাজধানীতে বিএনপি ও এর শরিক দলের সাতজন প্রার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে অনেক নেতা-কর্মীকে। পোস্টার লাগাতে গেলে বাধা আর লাগালে ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। এসব কারণে তারা ঠিকমতো নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারছেন না। জোরেশোরে প্রচারে নামার জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছেন তারা।

ঢাকা মহানগরের ১৫টি আসনের মধ্যে ১০টিতে বিএনপি প্রার্থী দিয়েছে। বাকি ৫টি শরিক দলকে ছেড়ে দিয়েছে দলটি। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে এখনো মাঠে নামতে পারেননি ঢাকা-১২ আসনের প্রার্থী সাইফুল আলম নীরব, ঢাকা-১০ আসনের প্রার্থী আবদুল মান্নান, ঢাকা-১৬ আসনের প্রার্থী আহসান উল্লাহ ও ঢাকা-১৫ আসনের প্রার্থী শফিকুর রহমান। তবে এই চার প্রার্থী নিজে নামতে না পারলেও তাদের অনুসারীরা বিক্ষিপ্তভাবে প্রচারপত্র বিতরণ করেছেন। এতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। সাইফুল আলম নীরবের বিরুদ্ধে মামলা আছে ২৬৭টি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই আমার নির্বাচনী আসনে নেতা-কর্মীদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দিচ্ছে। নিরীহ নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করছে। বুধবার রাতে হাতিরঝিল থানা যুবদলের সভাপতি মাসুদ পারভেজ রানার বাসায় পুলিশি তল্লাশি করা হয় এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া কয়েকজন নারী পোস্টার-লিফলেট বিতরণ করতে গেলে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। তারপরও স্বল্প পরিসরে প্রচারণা চলছে। দু-এক দিনের মধ্যে বড় ধরনের গণসংযোগও করা হবে।

এ ছাড়া একই ঘটনা ঘটানো হয় শেরেবাংলা নগর থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সালামত খান সজীব ও শেরেবাংলা নগর থানা যুবদলের সভাপতি অপুর বাসায়ও। তিনি বলেন, প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে আমি প্রচারে না নামলেও প্রতিদিনই আমার সমর্থকরা প্রচারপত্র বিতরণ করছেন। এতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, ঢাকা-৯ আসনের প্রার্থী আফরোজা আব্বাসের প্রচারে তিন দিন হামলা হয়েছে। ঢাকা-৮ আসনে মির্জা আব্বাসের প্রচারেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই দুই প্রার্থী বৃহস্পতিবার প্রচারে নামেননি। প্রচারে হামলার পর নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্নের কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ঢাকা-৪ আসনের প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনিও বৃহস্পতিবার প্রচারে নামেননি। গণসংযোগ করে ধানের শীষে ভোট চান ঢাকা-১১ আসনের প্রার্থী শামিম আরা বেগম। তিনি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, আমাদের গণসংযোগে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। তবে পুলিশি বাধার কারণে আমাদের প্রচার কাজ পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পুলিশ আমাদের গণসংযোগের ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং তালিকা করে তাদের গ্রেফতার করছে। এভাবে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। সরকার মুখে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে এর কোনো মিল নেই।

ঢাকা-৭ আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী মোস্তফা মহসিন মন্টু সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে আমরা যেভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, সেভাবে এ ভোটে অংশ নিয়ে আমরা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব। মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকায় প্রচারণা করেন ঢাকা-১৩ আসনের প্রার্থী আবদুস সালাম। তিনি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় আদাবর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির হোসেন ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেনকে আটক করে পুলিশ। আমরা কীভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাব। ঘর থেকে বের হলেই গ্রেফতার হতে হয়। আমাদের নেতা-কর্মীদের পুলিশ যেখানে পাচ্ছে সেখানেই গ্রেফতার করছে। আমরা কোনোভাবেই ভোট চাইতে পারছি না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর