সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
চট্টগ্রামে বিপুল বিজয় আওয়ামী লীগের

নাছির ম্যাজিকে দুর্গেই কুপোকাত বিএনপি

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম

নাছির ম্যাজিকে দুর্গেই কুপোকাত বিএনপি

আ জ ম নাছির উদ্দিন

চট্টল মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের ক্যারিশমায় চট্টগ্রামে বিপুলভাবে জয়ী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্থানীয়রা বলছেন ‘নাছির ম্যাজিক’! যেন সত্তরের নির্বাচনের শোভা পেয়ে এ ম্যাজিকেই স্বস্তিতে আছে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ। আর দিনভর আওয়ামী লীগ মাঠে সরব থাকলেও দেখা মেলেনি বিএনপির নেতা কর্মীদের। যুক্তফ্রন্টের শরিক অন্যদেরও কোনো ‘রা’ ছিল না ভোট চলাকালে। প্রশাসনের সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যেও কর্মী সমর্থকদের স্বতঃস্ফূর্ততা বিজয় নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে কোন্দলসহ নানা কারণে মাঠছাড়া বিএনপির কর্মীরা। দলটির পোলিং এজেন্টও ছিল না মহানগরের কোথাও।

মহানগরের সবকটি আসনের কেন্দ্রগুলো ছিল অভিন্ন চিত্র।  নবান্নে কৃষকের স্বস্তির মতো ভোটশেষে প্রাপ্তির  ঢেঁকুড় এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হ্যাটট্রিক জয়ী আওয়ামী লীগের।

চট্টগ্রামকে বিএনপির দুর্গই বলা হতো। ২০১৪ সালে বিএনপিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চট্টগ্রামে সংখ্যাধিক আসনে জিতলেও ২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৩টি, আওয়ামী লীগ ৯টি ও জাতীয় পার্টি ১টি আসন পায়। এর আগে বিএনপি ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় নির্বাচনে ১২টি, ৯৬ সালে ৭ম জাতীয় নির্বাচনে ১১টি এবং ৯১ সালের ৫ম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ১১টি আসন পায়। এই বিবেচনায় চট্টগ্রামকে বিএনপির দুর্গই বলা হয়। আর  সেই দুর্গে এবার মেয়র নাছির ঝড়ে কূপোকাত হলো বিএনপি। শীর্ষ বিএনপি নেতারাও যেন ছেড়ে গেলেন রাজনীতির মাঠ। দিনভর নির্বাচন মনিটরিং করেন চট্টগ্রামের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন।

রাজনৈতিক তথ্য অভিজ্ঞরা মনে করেন, মহিউদ্দিন শূন্য চট্টগ্রামে মেয়র নাছিরের নির্বাচনী ম্যাজিকই এবারকার চট্টগ্রাম জয়ের মূল রসদ। মহানগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীহীন এই প্রথমবারের  জাতীয় নির্বাচনে সাংগঠনিক শক্তির পরীক্ষায় উতরে   গেলেন বর্তমান মেয়র। দীর্ঘদিনের বিভক্তি কাটিয়ে বঞ্চিত  অনেকের ক্ষোভ অভিমান ঝেড়ে সব নেতাকে এক কাতারে এনে বিজয় নিশ্চিতকে মেয়র নাছিরের সাফল্য বলেই মনে করছেন রাজনীতি সচেতনরা। তারা বলছেন, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ এখন  দেশের অন্যসব বিভাজন শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুসংগঠিত। নৌকার পক্ষে চট্টগ্রামে দল পুনর্গঠনের সফল কারিগর  মেয়র নাছির নিজেই গতকাল শহরের প্রত্যেকটি  কেন্দ্রে ভোটার আকর্ষণ ও শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণে দলের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগে সফল হন।

তিনি নিজেই চট্টগ্রাম বিভাগের একমাত্র ইভিএম আসন চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া)সহ শহর সংশ্লিষ্ট ৬টি আসনের অন্তত ৩০টি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। আর মহিউদ্দিন পুত্র ও চট্টগ্রাম-৯ আসনের নৌকার প্রার্থী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও দফায় দফায় মুঠোফোনে যোগাযোগ রাখেন মেয়র নাছিরের সঙ্গে। অন্য প্রার্থীদেরও মাঠ কর্মীদের  প্রচেষ্টায় আশ্বস্ত করেন মেয়র। এদিকে, নিরাপত্তা প্রশ্নে চট্টগ্রাম বিভাগজুড়েই জিরো টলারেন্সে ছিল যৌথবাহিনী। শুরু থেকেই নিরঙ্কুশ জয়ের স্বপ্নে বিভোর ছিল আওয়ামী লীগ। কান্ডারিহীন বিএনপিকে নিয়ে ছিল দ্বিধা সংশয়। দলটির এতটাই ছত্রভঙ্গ দশা ছিল যে শহরের কেন্দ্রগুলোতে পোলিং এজেন্টও ছিল না তাদের। পুরোদমে প্রচারণা শুরু হওয়ার পরও যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বাধীন বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের নিয়ে ম্রিয়মাণ রহস্যাবৃত তৎপরতা নিয়ে মাঠে হাজারো প্রশ্ন আর শঙ্কার মাঝেই ছিল প্রশাসনের সর্বোচ্চ সতর্কতা। প্রচারণায় পোস্টার লিফলেট বা পর্যাপ্ত মিছিল শোডাউনহীন বিএনপির নির্বাচনী গন্তব্য নিয়ে সাধারণ্যের মাঝেও ছিল নানা প্রশ্ন।

এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম জেলাসহ বিভাগের ১১  জেলাতেই এই প্রথম নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। এমন নিরঙ্কুশ বিজয়কে উন্নয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের  চেতনার পক্ষের অদম্য অগ্রযাত্রারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবেশবিদ প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী মনে করেন, এ বিজয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রতি মানুষের নিঃশর্ত আস্থার প্রকাশ।

জয়ের ব্যাপারে আগে থেকেই আশাবাদ জানান চট্টগ্রাম মহানগর সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের  চেয়ারম্যান এমএ সালাম ও দক্ষিণ জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান।

অন্য দিকে খোদ মহানগরেই বিএনপির শীর্ষ নেতা সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কর্মী সমর্থকদের ভোটের দিনেও  বিভক্তি দ্বন্দ্ব অবিশ্বাস সংশয়ের রেশ চুকেনি। সাইড লাইনে পড়ে অসন্তোষে ফুঁসেছেন সাবেক মেয়র মীর নাছির উদ্দিনসহ মনোনয়নবঞ্চিত অনেকেই। আ.লীগের যেমন একক সমন্বয়ক ছিলেন মেয়র নাছির, বিএনপির তেমন কারও তৎপরতা ছিল না।

বিভাগীয় কমিশনার ও রিটার্নিং অফিসার আবদুল মান্নান চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার সার্বিক পরিস্থিতি  বেশ উৎসবমুখর ছিল বলেই জানান। অনেকটা অভিন্ন মন্তব্য মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমানের।

গত সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা বিভাগীয় কমিশনার বলেন, বিভাগে সমতলে দুর্গম কোনো কেন্দ্র ছিল না। নিরাপত্তার দিক থেকেও ঝুঁকি ছিল না কোথাও। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে ৫, রাঙামাটিতে ২৩ ও বান্দরবানে ১১ কেন্দ্র দুর্গম ছিল। সড়ক যোগাযোগ না থাকায় হেলিকপ্টারে সেসব কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জাম পাঠানো হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর নাসিরনগর ও কুমিল্লার রাজনৈতিক উত্তাপের বিশেষ নজর ছিল প্রশাসনের।   নোয়াখালীর হাতিয়া ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপসহ উপকূলেও চমৎকার পরিবেশ বলে জানান এই রিটার্নিং অফিসার। সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দেন বিভাগীয় কমিশনার।

১৬টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেয় ১৩টি আসনে। মহাজোটের বাকি অন্য তিনটি আসনে জাতীয় পার্টি (জাপা) ১টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ১টি ও জাসদ ১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অন্যদিকে বিএনপি চট্টগ্রামে যুক্তফ্রন্টের শরিক এলডিপিকে  ২ ও রেজিস্ট্রিহীন জামায়াতে ইসলামীকে ১ ও কল্যাণ পার্টিকে ১টি আসনে মনোনয়নে ছাড়  দেয়। ১টিতে জোটগত সমঝোতা হয়নি বিএনপি জামায়াতের।

সর্বশেষ খবর