সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইতিহাস গড়লেন শেখ হাসিনা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ইতিহাস গড়লেন শেখ হাসিনা

বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়লেন শেখ হাসিনা। টানা ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তৃতীয় মেয়াদে আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন তিনি। নির্বাচনে হ্যাটট্রিক জয়ের রেকর্ড করে শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন। সমকালীন বিশ্বে এটি তার অনন্য রাজনৈতিক সফলতা। 

শুধু তাই নয়, তিন মেয়াদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং সর্বশেষ ২০০১ সালে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালনকালে তিনি কঠিন সময় পার করেছেন। ১৯৮১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। মেধা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা আর জনগণের ভালোবাসাকে পুঁজি করে তিনি অনুন্নত এক দেশকে তুলে এনেছেন মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে জীবনমানের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্যে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় সম্ভাবনাময় সোনার বাংলার দুয়ার। ১৫ আগস্টের ভয়াল রাতে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিহত হলেও তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। পরবর্তী ছয় বছর লন্ডন ও দিল্লিতে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় তাদের দুই বোনকে। কিন্তু ঘাতকদের ষড়যন্ত্র আর অনিরাপত্তার কারণে পরিবারের সবাইকে হারানোর পরও ছয় বছর দেশে ফিরতে পারেননি তারা। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সেদিনও তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে প্রবেশ করতে পারেননি। ১৯৮১ সালে তার অনুপস্থিতিতেই সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। তিনিই প্রথম জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। তারই নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করে, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।

দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হওয়ার পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন বিএনপি সরকারের দুঃশাসন আর নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। অক্লান্ত আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার বাধ্য হয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচন দিতে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়। তার সরকারের অন্যতম সাফল্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পাহাড়ি-বাঙালি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে স্বাক্ষরিত হয় এই শান্তি চুক্তি। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি তার সরকারের অন্যতম আরেকটি সাফল্য। ২০০১ সালে দেশের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত নীলনকশার নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেওয়া হয়। সরকার গঠন করে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট। আর দ্বিতীয়বারের মতো বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন  শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বেশ কয়েকবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। তবে সব অপচেষ্টা নস্যাৎ করে চারদলীয় জোট সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন শেখ হাসিনা। এরপর আসে এক-এগার।  তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রেফতার করে শেখ হাসিনাকে। রাজনীতিতে সৃষ্টি হয় নেতৃত্বশূন্যতা। হুমকির মুখে পড়ে দেশের গণতন্ত্র। গণরোষের মুখে একপর্যায়ে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকার। বিরাজমান গণতন্ত্রের সংকট কাটিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। গণতন্ত্রের নতুন এ সন্ধিক্ষণে দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের নতুন এক যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ পরিকল্পনায় বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৮ ভাগে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তিনি অসংখ্য সমস্যার জট খুলেছেন।  তিনি আমাদের দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার হাত থেকে পুনরুদ্ধার করেছেন। একই সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন।  জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। ’৭১ পেরিয়ে বয়সের কোঠায় ৭২ স্পর্শ করেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু চিন্তা ও কর্মে বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি। বিপুল তার প্রাণশক্তি এবং কর্মক্ষমতা। দেশের জনগণ এবং আওয়ামী লীগই তার আত্মার আত্মীয়, ধ্যান, জ্ঞান এবং সর্বক্ষণের সহযাত্রী। নিজেকে তিনি ‘আলোর পথযাত্রী’ বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে। পরিকল্পনা করেছেন চট্টগ্রামকে দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর বানানোর। বাস্তবায়ন হচ্ছে একশ ইকোনমিক জোন। অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে নজরকাড়া সাফল্য হিসেবে দেখা দিচ্ছে পদ্মা সেতু। পাশাপাশি চার লেন মহাসড়ক, উড়াল সড়ক এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। শেখ হাসিনার পরিকল্পনাতেই বাংলাদেশ এখন প্রায় সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল। পাওয়া যাচ্ছে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎও।

১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর দেশের অর্থনীতির প্রাণ কৃষিতে ভর্তুকি এবং প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ তার এই মূলমন্ত্রে ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। তার সঠিক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ এখন আমদানিনির্ভর জাতি থেকে রপ্তানিনির্ভর জাতিতে পরিণত হচ্ছে। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কৃষিখাতে ঘটে গেছে নীরব বিপ্লব। অর্থনৈতিক জোন, হাইটেক পার্ক, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অসংখ্য দৃশ্যমান মেগাপ্রকল্পে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। সুযোগ্য নেতৃত্ব এবং অসাধারণ ধীশক্তির স্বীকৃতি হিসেবে বহু

আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মোট ৪১টি পুরস্কার, পদক, ডক্টরেট ও সম্মাননা তিনি অর্জন করেছেন। এর মধ্যে জাতিসংঘের পুরস্কার রয়েছে কয়েকটি। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন তিনি। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় পদ্মা সেতু নির্মাণ, সমুদ্র সীমানা বিজয়, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, রাজধানীর যানজট নিরসনে তৈরি হয়েছে ফ্লাইওভার, জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়ে দরিদ্রতার হার নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, বিনামূল্যে এক কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বই বিতরণ, মাতৃত্বকালীন ভাতা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি, গরিব শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। এ ছাড়াও প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্র, দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনমিক জোন নির্মাণ, মোবাইল ও ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিতে সফলতা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে সফলতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ঝুলে থাকা

ছিটমহল সমস্যার সমাধান প্রমাণ দেয় তার নেতৃত্বের দক্ষতার।

বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সম্মানজনক সমাধান করেছেন তিনি। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তির মাধ্যমে সমুদ্রবিজয় একদিকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সংহত করেছে, অন্যদিকে ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা স্থলসীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আসা ১০ লাখের বেশি মানুষকে মানবিকতার জায়গা থেকে ঠায় দিয়েছেন তিনি। তার এই ভূমিকা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এজন্যই তাকে ‘মানবতার মা’ বলে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার লক্ষ্য ছিল দেশের সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। তিনি এই ‘ঘুণে ধরা সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গড়ার’ প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের স্কুলে যাওয়ার বয়সী প্রতিটি শিশু এখন প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের হার ৫৫ শতাংশ এবং ছেলেদের ৪৫ শতাংশ। শিক্ষার হার দাঁড়িয়েছে ৭২ শতাংশ। আমাদের জনগোষ্ঠীর গড় আয়ুষ্কাল ৭১ বছরে উন্নীত হওয়া, দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুমৃত্যু এবং মাতৃমৃত্যুর হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। তার দূরদর্শী পরিকল্পনা আর দক্ষ নেতৃত্ব বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর