১৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৭:২৯
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

পরিবারের একতা যেভাবে তারকাখ্যাতি এনে দিল এমবাপ্পেকে

অনলাইন ডেস্ক

পরিবারের একতা যেভাবে তারকাখ্যাতি এনে দিল এমবাপ্পেকে

পুরো বিশ্ব লিওলেন মেসি ও কিলিয়ান এমবাপ্পের দিকে তাকিয়ে। রবিবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনালে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে পরপর দুবার বিশ্বকাপ জেতার হাতছানি দিচ্ছে ২৩ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পের সামনে।

১৯৬২ সালে ২১ বছর বয়সী পেলে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জেতার পর থেকে আর কারোরই নেই এই অর্জন। পাঁচ গোল করে এবারের আসরে লিওনেল মেসির সাথে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলস্কোরার এখন তিনি।

দুই বিশ্বকাপ খেলে এরই মধ্যে ৯ গোল করে টুর্নামেন্টের ইতিহাসের ১৫তম সর্বোচ্চ স্কোরার তিনি। ফ্রান্সের ইতিহাসে বিশ্বকাপে তার চেয়ে বেশি গোল করেছেন শুধুমাত্র জা ফঁতে-যিনি ১৯৫৮ বিশ্বকাপে করেছিলেন ১৩ গোল। দ্রুতগতি সম্পন্ন এমবাপ্পে অবশ্য সেসব রেকর্ডই ভাঙার সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন। তবে ফুটবলের প্রতি এমবাপ্পের এই ভালবাসা বুঝতে হলে আপনাকে তার শুরুটা দেখতে হবে।

প্যারিসের উত্তরের ছোট্ট শহরতলি বন্ডিতে তার জন্ম। স্থানীয় ফুটবল ক্লাব বন্ডি এফসির মাঠের উল্টোদিকে দরিদ্র পরিবারদের জন্য নির্ধারিত একটি বাড়িতে থাকতেন কিলিয়ান এমবাপ্পে, তার বাবা উইলফ্রিয়েড, মা ফায়জা ও তার দত্তক নেয়া ভাই জিরেস কেম্বো-একোকো। কিলিয়ান এমবাপ্পের পনের বছর বয়েসী ছোট ভাই ইথানের তখনও জন্ম হয়নি। বাড়ির সামনে একটা রাস্তা পার করলেই ছিল মাঠ, আর সেখানে কিলিয়ান এমবাপ্পে তার বন্ধুদের সাথে সারাদিন খেলতে পারতেন।

স্থানীয় ক্লাবের তৃণমূল পর্যায়ের সাথে তার বাবা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। স্থানীয় বিভিন্ন দলের কোচ ছিলেন তিনি, ফলে সেখানকার ফুটবল অঙ্গনে বেশ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হত। তার ছেলেও ফুটবল ছাড়া আর কোনকিছুতেই আগ্রহী ছিল না। কিলিয়ান এমবাপ্পের সব চিন্তাভাবনা ছিল ফুটবল ও তার বাবার দলকে ঘিরে। তার পরিবারের সবাই এক অর্থে ছিল ফুটবল পাগল।

টেলিভিশনে খেলা দেখা থেকে শুরু করে স্কুলের ফুটবল টিম বা বন্ডিতে কোনো ফুটবল টিমে খেলাই ছিল কিলিয়ান এমবাপ্পে ও তার পরিবারের একমাত্র চিন্তার বিষয়। কিলিয়ান এমবাপ্পে ফুটবল শুধু খেলতোই না, তার শ্বাস-প্রশ্বাসে, শয়নে-স্বপনে ছিল ফুটবল। ছবিতে তার বেডরুমেরর ওয়ালে তার আইডল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পোস্টার আপনি হয়তো দেখে থাকবেন।

অনেক আগে থেকেই এটা পরিষ্কার ছিল যে ফুটবলে তরুণ এমবাপ্পের বিশেষ প্রতিভা রয়েছে। তার বয়স যখন ১০, তখনই প্যারিস এবং আশেপাশের মানুষের মুখে মুখে ছিল বন্ডি অঞ্চলের আসন্ন এক ফুটবল মহাতারকার গল্প। অল্পদিনের মধ্যেই এই ফুটবলারের গল্প ফ্রান্সের রাজধানীর গন্ডি ছাড়িয়ে যায়। ফরাসী প্রিমিয়ার লিগের পাশাপাশি ইউরোপের বড় বড় সব ক্লাবের স্কাউটরা তাদের ক্লাবকে জানান দেয় এই প্রতিভার আগমন সম্পর্কে।

এমবাপ্পে পরিবারের পরিকল্পনা অবশ্য পরিষ্কার ছিল। তারা একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল যে এমবাপ্পে তার পরবর্তী কয়েক বছর ফ্রান্সেই কাটাবেন, তবে তারা চাইছিলেন এমবাপ্পে যেন সেরাদের সাথে খেলার মধ্যে থাকেন। তাই তারা ইংলিশ ক্লাব চেলসির প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এগারো বছর বয়সে এমবাপ্পে এক সপ্তাহের জন্য চেলসিতে ট্রেনিং করেন। তার বয়স যখন ১২ তখন রিয়াল মাদ্রিদেও এক সপ্তাহ ট্রেনিং করেন তিনি।

দুই ইউরোপিয়ান জায়ান্টই এমবাপ্পে ও তার বাবা-মাকে লন্ডন অথবা স্পেনে এসে থাকতে রাজি করাতে চেয়েছিল, যার জন্য তারা যে কোনো অঙ্কের অর্থ খরচ করতেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এমবাপ্পে পরিবার শুধু চেয়েছিল তাদের ছেলের পরীক্ষা নিতে।

এমবাপ্পে যেখানেই গিয়েছে, সেখানেই সে সবার সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে-এমনকি ক্লেয়ারফঁতে অ্যাকাডেমিতেও, যেটিকে প্যারিসের তরুণ খেলোয়াড়দের সবচেয়ে অভিজাত অ্যাকাডেমি মনে করা হয়। সেখানে শত শত ১৩-বছর বয়সী খেলোয়াড়দের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর দু’বছর থাকতে হয় এবং সপ্তাহের ছুটির দিনে খেলোয়াড়রা তৃণমূলের কোনো ক্লাব বা পেশাদার ক্লাবের হয়ে ম্যাচ খেলে থাকেন।  

এমবাপ্পেকে দলে নেয়ার জন্য অনেক ক্লাবই আগ্রহ দেখায়, কিন্তু অ্যাকাডেমির অন্যান্য সতীর্থদের মতো কোনো ক্লাবে যোগ না দিয়ে তিনি ক্লেয়ারফঁতেঁতে দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষ করেন।

ফরাসী ক্লাব কঁও ধরেই নিয়েছিল যে তারা এমবাপ্পেকে পেয়ে গেছে। তবে এমবাপ্পে পছন্দ করে মোনাকোকে, কারণ মোনাকো তাকে বলেছিল যে সে মূল দলে খেলতে পারবে। সেসময় এমবাপ্পের বয়স ছিল ১৫ এবং তার স্বপ্ন ছিল শুধু ফুটবল খেলা। ফুটবলের জন্য তার আবেগ ছিল তুলনাহীন।

মোনাকো অ্যাকাডেমিতে যুব দলের হয়ে যখন তিনি নিয়মিত খেলছিলেন, তখনই তার আইডল রোনালদোর মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি। তার পরিবারও তার সাথে মোনাকোতে চলে আসে এবং সেখানেই থাকতে শুরু করে।

তাই এমবাপ্পের সাফল্যের রহস্য বুঝতে তার পরিবারকে বোঝাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পরিবার হিসেবে তারা সব কাজ একসাথে করে থাকেন। এমবাপ্পে পরিবারের যখন মনে হয় যে প্রশিক্ষণে ভালো পারফর্ম করার পরও এমবাপ্পেকে প্রথম একাদশে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না, তখন তারা প্রতিবাদ করে।

ফলস্বরুপ মোনাকোর কোচ লিওনার্ডো জারদিম ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এমবাপ্পেকে অভিষেকের সুযোগ করে দেন। ১৬ বছর ৩৪৭ দিন বয়সে মোনাকোতে খেলে মোনাকোর কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে ফরাসী ফরোয়ার্ড থিয়েরি অঁরির রেকর্ড ভাঙেন এমবাপ্পে।

ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে ট্রয়ের বিপক্ষে গোল করে ১৭ বছর ৬২ দিন বয়সে মোনাকোর কনিষ্ঠতম গোলস্কোরার হিসেবেও অঁরির রেকর্ড ভাঙেন তিনি।

তারপর থেকে কিলিয়ান এমবাপ্পেকে আর কিছুই থামাতে পারেনি। পঁচিশে মার্চ ২০১৭’তে স্পেনের বিপক্ষে ফ্রান্সের হয়ে তার প্রথম ম্যাচ খেলার কয়েকমাসের মধ্যেই ফ্রান্সের হয়ে প্রথম গোল করেন তিনি।  

তার কৈশোরে ইউরোপের বড় সব ক্লাবই তাকে দলে নেয়ার চেষ্টা করে। তাকে দলে নেয়ার জন্য যা করা দরকার, রিয়াল মাদ্রিদ তার সবই করেছে। তারা একাধিক ট্রায়াল, ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, বৈঠক আয়োজন করার পাশাপাশি সেসময়কার ম্যানেজার জিনেদিন জিদান ও এমবাপ্পের আইডল রোনালদোর সাথেও সাক্ষাতের আয়োজন করে।

কিলিয়ান এমবাপ্পেকে দলে নেয়ার জন্য তারা সবরকম প্রস্তাবই দিয়েছে। তাদের সেই প্রচেষ্টা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আগাস্ট ২০১৭’তে এক মৌসুমের জন্য ধারে পিএসজিতে যোগ দেন এমবাপ্পে। তার পরের বছর ১৩ কোটি ইউরোতে পিএসজিতে যোগ দেয়ার পর থেকে পাঁচ মৌসুম খেলে দলকে চারটি লিগ শিরোপা জেতান।

এর পরের অংশটা ইতিহাস, আর তা সবারই জানা। ২০১৮ বিশ্বকাপ বিজয়ী এমবাপ্পের স্বপ্ন ছিল শুধু ফুটবল খেলা, তার চালিকাশক্তি ছিল ফুটবলের জন্য তার ভালবাসা। আর তার সেই ভালবাসাকে লালন করে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার পেছনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল তার পরিবারের।  

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর